guruji call istd 0091 0153760753

guruji call istd 0091 0153760753
হিন্দু বাড়িতে তুলসী গাছ থাকে কেন ?
14জু
তুলসী (Tulsi/Holy Basil/ thai Krapho) একটি Lamiaceae family এর অন্তর্গত সুগন্ধি বীরুত্ জাতীয় উদ্ভিদ যার বৈজ্ঞানিক নাম Ocimum sanctum (sanctum অর্থ পবিত্র স্থান) । হাজার হাজার বছর ধরে সাধারণত কৃষ্ণ ও রাধা তুলসী এই দুই প্রকারে প্রাপ্ত তুলসী হিন্দু গৃহে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়ে আসছে যেহেতু এর পিছনে রয়েছে ধর্মীয় ,পরিবেশগত ও বৈজ্ঞানিক কারণ ।
ধর্মীয় কারণ :ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে তুলসীকে সীতাস্বরূপা ,স্কন্দপুরাণে লক্ষীস্বরূপা,চর্কসংহিতায় বিষ্ণুর ন্যায় ভুমি,পরিবেশ ও আমাদের রক্ষাকারী বলে বিষ্ণুপ্রিয়া ,ঋকবেদে কল্যাণী বলা হয়েছে । স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু তুলসী দেবীকে পবিত্রা বৃন্দা বলে আখ্যায়িত করে এর সেবা করতে বলেছেন।
পরিবেশগত কারণ : পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে তুলসীগাছ একমাত্র উদ্ভিদ যা দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা অক্সিজেন সরবরাহ করে বায়ু বিশুদ্ধ রাখে যেখানে অন্য যেকোন গাছ রাত্রিতে কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে তাই রাতের বেলাতে তুলসীতলায় শয়ন করাও ব্যক্তির জন্য উপকারী।এছাড়া তুলসীগাছ ভুমি ক্ষয় রোধক এবং তুলসী গাছ লাগালে তা মশা কীটপতঙ্গ ও সাপ থেকে দূরে রাখে।
বৈজ্ঞানিক ও স্বাস্থ্যগত কারণ:
*তুলসীতেEugenolঅধিক পরিমাণে থাকায় তা Cox-2 Inhibitorরূপে কাজ করে বলে তা ব্যথানাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
*Hypoglycemic drugs এর সাথে তুলসী খেলে তা টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগে দ্রুত গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
*তেজস্ক্রিয়তার ফেলে ক্ষতিগ্রস্থ কোষসমুহকে মেরামত করে।
*চর্বিজনিত হৃদরোগে এন্টি অক্সিডেন্টের ভুমিকা পালন করে।
*তুলসী একশেরও বেশি Phytochemicals(যেমন oleanolic acid ,beta caryophyllene ইত্যাদি)বহন করে বলে ক্যান্সার চিকিত্সায় ব্যবহৃত হয়।
*তুলসীর অ্যালকোহলিক নির্যাস Immune system এর রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে।
*তুলসী স্নায়ুটনিক ও স্মৃতিবর্ধক।
*শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্নরোগ যেমন ব্রঙ্কাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ,হাঁপানি প্রভৃতি রোগের নিরাময়ক।
*সর্দি ,কাশি, জ্বর, বমি, ডায়ারিয়া ,কলেরা , মুখের আলসারসহ চোখের বিভিন্ন রোগে ইহা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
*দাঁতের রোগে উপশমকারী বলে টুথপেস্ট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
বেদ
14জু
ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো অতুলনীয়। আজ থেকে দু কি তিন হাজার বছর আগেও তো ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র অমলিন ছিল না। বরং আরও সমুজ্জ্বল থাকারই সম্ভাবনা। তখন তো কলকারখানা ছিল না। আকাশ ছিল নীলাভ ও নির্মল। মেঘেরাও। সে সময়ে শীতকালেও খুব বৃষ্টি হত নাকি।
মনে হয়, ভারতবর্ষের প্রাচীন মানুষেরা প্রাকৃতিক শক্তি বা সৌন্দর্য দেখে নিশ্চয়ই অভিভূত হয়েছিল ।
আর ঋষিরা?
ঋষিরা যেহেতু ব্যাতিক্রমী হৃদয়ের অধিকারী, কাজেই তারা সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ বা ভীত হয়ে গিয়ে রচনা করলেন মন্ত্র: যাকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয়, স্তোত্র বা সূক্ত। কাজেই প্রাচীন ভারতের ঋষিরা, সর্বমোট যে ২০,৩৭৯ টি সূক্ত রচনা করেছিলেন তারই সংকলনকে বলা হয় বেদ। কেননা বেদ-এ রয়েছে সর্বমোট ২০,৩৭৯টি মন্ত্র বা ঋক।
প্রাচীন ভারতকে বলা হয় বৈদিক ভারত। ওই বৈদিক কথাটা এসেছে বেদ থেকেই। বৈদিক সমাজে দারুণ প্রভাব ছিল গ্রন্থটির।
সহস্র মন্ত্রের সমষ্টি বলেই বেদ অনির্বায ভাবেই ধর্মীয় গ্রন্থ । প্রাচীন ভারতেই গ্রন্থটি রচিত ও সঙ্কলিত হয়েছিল আজ থেকে ৩ বা সাড়ে ৩ হাজার বছর আগে; গবেষকরা এমনই মনে করেন।
দীর্ঘকাল বেদ বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। পরে বেদ সঙ্কলন করলেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস। ইঁনিই রচেছিলেন মহাভারত।
বেদ-এর ভাষা আদি সংস্কৃত। সাধারন মানুষ তো দূরের কথা; অতি শিক্ষিত পন্ডিতেও টীকাভাষ্য বাদে বেদ বোঝে না। সবচে ভালো টীকা নাকি লিখেছেন সায়নাচার্য। জানি না। আমি বেদজ্ঞ নই। তবে বেদ বোঝার জন্য টীকাভাষ্যের দরকার হয়। কেননা, বৈদিক যুগে একই শব্দের বিভিন্ন অর্থ হত। যেমন: “গো” শব্দের অর্থ হতে পারত জল রশ্মি বাক্য পৃথিবী গরু।
মনে করা হয় যে যিশুখ্রিস্টের জন্মের ১৫০০ বছর আগে আর্যরা পারস্য হয়ে প্রাচীন ভারতে এসেছিল প্রাচীন । তার আগেই প্রাচীন ভারতে হরপ্পা ও মহেনজোদারো সভ্যতা প্রায় ধ্বংসের মুখে এসে পৌঁছেছিল। তো, আর্যরা প্রথমে ভারতবর্ষের পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে; আরও পরে তারা পূবের গাঙ্গেয় অববাহিকা অবধি পৌঁছেছিল।
এভাবেই সূচিত হয়েছিল বৈদিক যুগের।
বৈদিক ঋষিরা বেদ লিখেছিল ভোজ নামে এক ধরনের গাছের পাতার ওপর। এই ভূর্জপত্র বা ভোজ পাতাই হল প্রাচীন ভারতের প্যাপিরাস।
সেই বৈদিক যুগেই গড়ে উঠেছিল বেদ-এর কনসেপ্ট।
তো বেদের কনসেপ্ট বা বিষয় কি?
বেদের কনসেপ্ট বা বিষয় হল দেবতা ও যজ্ঞ।
দেবতা কি তা জানি। কিন্তু, যজ্ঞ কি?
দেবতার উদ্দেশ্যে দ্রব্য ত্যাগই যজ্ঞ।
বৈদিক যজ্ঞে নাকি রাশি রাশি কাঠ, মন মন ঘি পুড়ত। শত শত ছাগ, শত শত ষাঁর রীতিমতো বলি হয়ে যেত।
বেদে নানা দেবতার কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন, অগ্নি ছিলেন বেদ-এর একজন প্রধান দেবতা।অন্য দেবতারা হলেন: বায়ূ জল সূর্য উষা পৃথিবী আকাশ।
আগেই বলেছি, বৈদিক ঋষিরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গিয়ে রচনা করেছিলে স্তোত্র বা সূক্ত বা মন্ত্র। তো, তখনকার সমাজে লোকে বিশ্বাস ছিল যে বিশেষ উপায়ে এসব দেবদের ভজনা করলে সুখশান্তি মেলে; বিপদ ধারেকাছেও ঘেঁষে না, উপরোন্ত ধনবৃদ্ধি হয়। কী করে দেবদের ভজনা করা যায় সে পথ দেখাত বেদ। কাজেই বেদ ছিল বেস্ট সেলার। তবে গ্রন্থটি সবাই পাঠ করতে পারত না। কেবল ব্রাহ্মণরাই এটি পড়তে পারত ব্যাখ্যা করতে পারত; অন্যরা নয়। বৈদিক সমাজে তখন বর্ণপ্রথা ছিল।
বৈদিক সমাজে সবচে নিচে ছিল শূদ্ররা। এরা আসলে ছিল আর্য-পূর্ব ভারতের অধিবাসী। আর্যরা এদের পরাজিত করে দাসে রুপান্তরিত করেছিল। শূদ্ররা বেদ শ্রবণ করলে বা শুনলে নাকি ওদের কানে গরম সিসা ঢেলে দেওয়া হত!
তো বেদ কিন্তু একটি গ্রন্থ নয়। বেদ চারটি। যথা:ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। বেদের মধ্যে ঋগ্বেদই প্রচীনতম। এর অধিকাংশ সূক্তেই বিভিন্ন দেবতার বর্ণনা ও প্রশস্তি লিপিবদ্ধ আছে। যজুর্বেদ গদ্যে লেখা এবং এটি দুভাগে বিভক্ত। শুল্ক ও কৃষ্ণ যজুর্বেদ; এতে নানা কাহিনী রয়েছে। যেমন গুরু বৈশম্পায়ণ ও শিষ্য যাজ্ঞবল্ক্যের কাহিনী আমরা যজুর্বেদ-এই পাই। শুল্ক যজুর্বেদ মন্ত্রের সঙ্কলন। আর কৃষ্ণ যজুর্বেদ এ মন্ত্র থাকলেও গল্প রয়েছে। এটিকে ভারতীয় পুরাণের উৎস বলা যেতে পারে। সামবেদ বিভিন্ন ঋষিরচিত সূক্তের সংকলন। এ জন্য এটিকে সামবেদ-সংহিতাও বলা হয়। এটি একটি সঙ্গীত গ্রন্থ। বৈদিক যজ্ঞে যে সঙ্গীতের প্রচলন ছিল তা সামবেদ থেকেই নেওয়া। সামবেদের ৭৫টি মন্ত্র বাদ দিলে বাকি সব সূক্ত ঋগ্বেদ
থেকে নেওয়া। অথর্ববেদ: আগের বেদগুলার বিষয় ছিল কেবল মোক্ষ। অথর্ববেদ-এ মোক্ষ ছাড়াও ধর্ম অর্থ ও কাম বিষয় হিসেবে প্রযুক্ত হয়েছে। তা ছাড়া এটি ভারতীয় আয়ুবের্দ শাস্ত্রেরও উৎস। পাপক্ষয়, শক্রজয় বিষয়ক নানা বশীকরণ মন্ত্র রয়েছে এটিতে । সবচে বিস্ময় যে – অথর্ববেদ-এ রয়েছে আর্য ঐক্যের আহবান। অনার্যদের নিশ্চিহ্ন করার ইঙ্গিত!
প্রতিটি বেদ কয়েকটি মন্ডল বা অধ্যায়ে বিভক্ত। মন্ডলে রয়েছে সূক্ত। প্রতিটি সূক্তে রয়েছে বেশ কটি ঋক বা মন্ত্র। আগেই একবার উল্লেখ করেছি, বেদে সর্বমোট মন্ত্রের বা ঋকের সংখ্যা ২০,৩৭৯।
যা হোক। প্রাচীন বৈদিক সমাজেই বেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছিল। যিশুর জন্মের ৬০০/৭০০ বছর আগে বৈদিক সমাচে বেদবিরোধী প্রতিবাদী চিন্তাবিদের জন্ম হল। যেমন: চার্বাক মহাবীর বুদ্ধ। বৈদিকরা এদের বলল নাস্তিক।
পরবর্তীকালে বেদবিরোধীরা ভারতবর্ষে টিকে থাকতে পারেনি। ওদের যথা সময়ে হটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভারতবর্ষ থেকে অন্যত্র পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছিল বৌদ্ধধর্ম। জৈনধর্ম কেবল ভারতবর্ষে আজও টিকে আছে; কারণ, ধর্মটি নানা বৈদিক আচারপ্রথা গ্রহন করেছিল বহুকাল আগেই। চার্বাক ঋষি কি বলেছেন না বলেছেন সে সব এখন পন্ডিতদের গবেষনার বিষয়। ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।
কাজেই সংশয়ীদের হটিয়ে বেদ আবার ফিরে আসে। তাছাড়া বেদভিত্তিক ধর্মের উত্থান হয়েছিল খ্রিস্টীয় ষষ্টসপ্তম শতকে। ব্রাহ্মণ্যবাদী পৌরানিক ধর্মের উত্থান ঘটে তখনই। পৌরানিক ধর্মের ভিত্তি ছিল ভারতবর্ষের সমাজে প্রচলিত পুরাণ। আগেই বলেছিকৃষ্ণ যজুর্বেদ কে ভারতীয় পুরাণের উৎস বলা যেতে পারে।
ভারতীয় সমাজে আজও বেদ-এর প্রাধান্য। তার কারণ বিশেষ উপায়ে দেবতার ভজনা করলে সুখশান্তি মেলে, বিপদ আসে না, ধনবৃদ্ধি হয়-ভারতের সাধারণ মানুষের এরকম বিশ্বাস। বেদের দেবতারা অপসৃত হয়ে গেছে কবে। তবে মূল কনসেপ্টটি আজও অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে- পূজো-অর্চনা করে দেবতাকে সন্তুষ্ট করা। বেদের প্রধানতম দেবতা ছিল অগ্নি ।
কৃত্তিবাস ওঝা(রামায়নের বাংলা অনুবাদকারী)
14জু
কৃত্তিবাস ওঝা (জন্মঃ আনুমানিক ১৩৮১ বঙ্গাব্দ – মৃত্যুঃ আনুমানিক ১৪৬১ বঙ্গাব্দ) ছিলেন মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান কবি। তিনি অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার অন্তর্গত ফুলিয়া গ্রামে বাস করতেন। গৌড়েশ্বরের আদেশে তিনি বাল্মীকি রামায়ণেরসহজবোধ্য বাংলা পদ্যানুবাদ করেছিলেন।]তাঁর অনূদিত রামায়ণ কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে পরিচিত। কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এটি মূল রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয়। কৃত্তিবাস রামায়ণ-বহির্ভূত অনেক গল্প এই অনুবাদে গ্রহণ করেছিলেন। তদুপরি বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা অনুষঙ্গের প্রবেশ ঘটিয়ে তিনি সংস্কৃত রামায়ণ উপাখ্যানের বঙ্গীকরণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, এই কাব্যে “প্রাচীন বাঙালি সমাজই আপনাকে ব্যক্ত করিয়াছে।” বাঙালি সমাজে এই বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়। কয়েক শতাব্দী ধরে বইটি বাংলা ঘরে ঘরে পঠিত। বাঙালি সমাজে এই বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়। কয়েক শতাব্দী ধরে বইটি বাংলা ঘরে ঘরে পঠিত। ১৮০২ সালে উইলিয়াম কেরির প্রচেষ্টায় শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে কৃত্তিবাসী …রামায়ণ প্রথম মুদ্রিত হয়।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এর কোনো কোনো পুঁথি থেকে “কৃত্তিবাসের আত্মপরিচয়” শীর্ষক একটি অসম্পূর্ণ অধ্যায় পাওয়া যায়। এই অধ্যায় থেকে কবির বংশপরিচয়, ব্যক্তিপরিচিতি ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে অনেক তথ্যের সন্ধান মেলে। কবির পূর্বপুরুষ নরসিংহ ওঝা ছিলেন পূর্ববঙ্গের বেদানুজ রাজার অমাত্য। তাঁরা ছিলেন “মুখুটি” (মুখোপাধ্যায়) বংশজাত। পারিবারিক শিক্ষকতা বৃত্তির জন্য “উপাধ্যায়” পদবি লোকমুখে বিকৃত হয়ে হয় “ওঝা”। পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নরসিংহ ওঝা নদিয়ায় চলে এসে ফুলিয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর পুত্র গর্ভেশ্বর। গর্ভেশ্বরের পুত্র মুরারি। মুরারির সাত পুত্রের অন্যতম ছিলেন কৃত্তিবাসের পিতা বনমালী। কৃত্তিবাসের মায়ের নাম ছিল মালিনী। কৃত্তিবাসেরা ছিলেন ছয় ভাই। তাঁদের এক বৈমাত্রেয় বোনও ছিল। ভাইদের মধ্যে কৃত্তিবাস ছিলেন জ্যেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা অধিক গুণবান।
বারো বছর বয়সে কৃত্তিবাস গঙ্গা নদী পার হয়ে উত্তরবঙ্গে গুরুগৃহে বিদ্যাশিক্ষা করতে যান। শিক্ষাশেষে রাজপণ্ডিত হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে গৌড়েশ্বরের রাজসভায় উপস্থিত হন এবং একটি সরস শ্লোকরচনা করে রাজাকে তুষ্ট করেন। রাজা একটি পুষ্পমাল্য দিয়ে কবিকে বরণ করে নেন। রাজা কবির প্রত্যাশা জিজ্ঞাসা করলে, কবি বলেন
“ আর কিছু নাঞি চাই করি পরিহার।
যথা যাই তথায় গৌরবমাত্র সার।। ”
কবির উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে রাজা তাঁকে রামায়ণ রচনার নির্দেশ দেন। রাজার আদেশে কৃত্তিবাস তাঁরশ্রীরাম পাঁচালী রচনা করেন।
পূজা কেন করা হয় পূজা কাকে করা হয়
14জু
সাধকানাং হিতার্থায়ৈ ব্রহ্মণে রূপকল্পনা …
পূজা করা হয় ‘চৈতন্যময়ী’ প্রকৃতিকে। কেন করা হয়? চৈতন্যময়ী প্রকৃতিকে তুষ্ঠ করতেই পূজা করা হয়; যাতে পূজারী/ভক্তের জীবন হয়ে ওঠে আনন্দময়, হয়ে ওঠে কল্যাণময় । কিন্তু, প্রকৃতিকে কেন চৈতন্যময়ী বলে মনে করা হয় ? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা একটু পরে খুঁজব। তার আগে বলি যে, বাংলায় ‘পূজার’ ধারণাটি অতি সুপ্রাচীন। প্রায় তিন হাজার বছর আগে প্রাচীন বাংলায় ‘পূজার’ প্রাথমিক ধারণার উন্মষ বলে মনে করা হয়। কেননা, ‘পূজা’ শব্দটি কিন্তু বৈদিক আর্য দের সংস্কৃত ভাষার শব্দ নয়; ‘পূজা’ শব্দটি অস্ট্রিক ভাষার একটি শব্দ। সুপ্রাচীন বাংলার মানুষ কথা বলত ওই অস্ট্রিক ভাষায়।
সেই প্রাগৈতিহাসিক সময়ে সুপ্রাচীন বাংলায় বাস করত কিরাত ও আদি- অস্ট্রাল জাতি । তবে সুপ্রাচীন বঙ্গে কিরাতদের সংখ্যা ছিল কম; এদের চেহারা ছিল মঙ্গোলয়েডদের মত এবং আদি-অস্ট্রালদের সংখ্যা ছিল বেশি; এদের চেহারা ছিল অষ্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসীদের মতন! এরাই ছিল বাঙালির পূর্বপুরুষ; এরাই কথা বলত ‘অষ্ট্রিক’ ভাষায়। ‘পূজা’ শব্দটি সুপ্রাচীন বাংলায় প্রচলিত এই অস্ট্রিক ভাষারই শব্দ। এরাই প্রকৃতিকে ‘চৈতন্যময়ী’ মনে করত। ‘চৈতন্যময়ী’ প্রকৃতিকে পূজা করত।
তা হলে প্রাচীন বাংলার অষ্ট্রিকভাষী কিরাত ও আদি- অস্ট্রাল জাতি ‘চৈতন্যময়ী’ প্রকৃতিকে পূজা করলেও বর্তমানে কালীপূজা এবং শারদীয় দূর্গাপূজার মন্ত্রপাঠ এবং অন্যান্য কৃত্যের ক্ষেত্রে কেন সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করা হয়? বিশেষ করে আমরা দূর্গাপূজার সময় দূর্গাকে ‘বিদ্যা রূপেণ সংস্থিতা’,কিংবা ‘জ্ঞান রূপের সংস্থিতা’ এসব অভিধায় ভূষিতা হতে শুনি। এর কারণ কী।
খুলে বলছি। পন্ডিতদের অনুমান, বৈদিক আর্যরা প্রাচীন বাংলায় এসেছিল পশ্চিম দিক থেকে । সময়টা? ৮০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বের মধ্যে। কিরাত ও আদি অস্ট্রালরা অরণ্যচারী শিকারী ছিল বলেই বৈদিক আর্যরা তাদের বলত ‘নিষাদ’ ( এর মানে ‘ব্যাধ’ বা ‘শিকারী’) জাতি । তারপর কি হল? আর্যদের বৈদিক ধর্মীয় বিশ্বাস নিষাদরা গ্রহন করল। এর মানে প্রাচীন বাংলার নিষাদ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার-আচরণ ইত্যাদি বদলে গিয়েছিল। বৈদিক ধর্মশাস্ত্র সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়েছিল বলে এবং সেই প্রাচীন সময়ে জীবনের প্রতিটি স্তরেই ধর্মীয় বিধিনিষেধ প্রবল ছিল বলেই প্রাচীন বাংলার নিষাদরা তাদের নিজস্ব ভাষার বদলে সংস্কত ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
অবশ্য আর্যরাও অনার্য নিষাদদের ধর্মীয় চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়েছির।
অনার্য নিষাদদের আদিম ও স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মবিশ্বাস ছিল সাংখ্য, তন্ত্র এবং যোগ। আর্যরা এই তিনটি মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন:
বৈদিক ভাষায় দেশী শব্দ যেমন গৃহীত হয়েছে, তেমনি যোগপদ্ধতিও হয়েছে প্রবিষ্ট। বস্তুত এই দ্বিবিধ প্রভাব ঋগে¦দেও সুপ্রকট। তা ছাড়া দেশী জন্মান্তরবাদ, প্রতিমা পূজা, নারী, পশু ও বৃক্ষ-দেবতার স্বীকৃতি, মন্দিরোপসনা,ধ্যান, কর্মবাদ, মায়াবাদ এবং প্রেততত্ত্ব দেশী মানস প্রসূত। কাজেই যোগ ও তন্ত্র সর্ব ভারতীয় হলেও অষ্ট্রিক,নিষাদ ও ভোট -চীনা কিরাত অধ্যূষিত বাঙলা-আসাম-নেপাল অঞ্চলেই হয়েছিল এসবের বিশেষ বিকাশ। যোগীর দেহশুদ্ধি এবং তান্ত্রিকের ভূতশুদ্ধি মূলত অভিন্ন ও একই লক্ষ্যে নিয়োজিত। বহু ও বিভিন্ন মননের ফলে, কালে ক্রমবিকাশের ধারায় সাংখ্য, যোগ এবং তন্ত্র -তিনটে স্বতন্ত্র দর্শন ও তত্ত্বরূপে প্রতিষ্ঠা পায়। এবং প্রাচীন ভারতের আর আর ঐতিহ্যের মতো এগুলি আর্যশাস্ত্র ও দর্শনের মর্যাদা লাভ করে।(বাঙলা বাঙালি ও বাঙালীত্ব; পৃষ্ঠা,৪১)
আর এভাবেই বৈদিক আর্যদের সংস্কৃত ভাষায় নিষাদদের মাতৃভাষার শব্দও গৃহিত হয়েছিল। যেমন: ‘পূজা’ শব্দটি। ‘পূজা’ শব্দের অর্থ-শ্রদ্ধা। এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এরকম।
(১ ) প্রাকৃতিক শক্তিকে ‘চৈতন্যময়ী’ বলে মনে করা;
(২) সেই চৈতন্যময়ী শক্তিকে নিষাদের মানবীয় উপলব্দির সীমানায় নিয়ে আসা;
(৩) সেই চৈতন্যময়ী শক্তির সঙ্গে মাতাপিতার সর্ম্পক স্থাপন করা; এবং
(৪) সেই চৈতন্যময়ী শক্তির পূজা করা।
এই ছিল প্রাচীন বাংলার নিষাদদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং কৃত্য (রিচুয়াল)। তবে পূজা করার আরেকটি কারণ হল: ভক্তি । এই বিষয়টি সহজেই বোঝা যায়। পূজারীর হৃদয়ে ভক্তি না এলে সে পূজারই-বা কি অর্থ? এই কথাটা আমরা সহজেই উপলব্দি করতে পারি। ভক্তির উন্মেষ যে সুপ্রাচীন বাংলার নিষাদসমাজেই হয়ে এটি আমরা অনুমান করতে পারি।
কিন্তু, নিষাদরা প্রকৃতিকে কেন ‘চৈতন্যময়ী’ বলে মনে করেছিল ?
নিষাদদের কৌম (গোত্রীয়) সমাজটির গড়ন ছিল মাতৃতান্ত্রিক। সমাজবিকাশের অনিবার্য নিয়মে প্রথমে নিষাদসমাজ ছিল শিকারী ও খাদ্যসংগ্রকারী। তারা বাংলার প্রাচীন অরণ্যে ফলমূল কুড়োত। পরে হাতিয়ারের উন্নতি হল; তারা বনভুমি কেটে জমি চাষ করতে থাকে। এভাবে ওদের কৃষিজীবনে উত্তরণ ঘটে । তবে অনুন্নত হাতিয়ারের (টুলস) কারণে কৃষিজীবন ছিল ভারি অনিশ্চিত। ওদিকে গোত্রের জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছিল। কাজেই প্রকৃতির কৃপার ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় কী! সেই আদিম নিষাদসমাজটি মাতৃতান্ত্রিক ছিল বলেই প্রকৃতিকে তারা ‘চৈতন্যময়ী’ ভেবেছিল। তারা নারীকে জগতের আদি কারণ বলেও ভাবল । কাজেই অদৃশ্য প্রকৃতিক শক্তিটি ওদের আদিম মনে একজন দেবী হিসেবে প্রকাশ পেলেন, দেবতা হিসেবে নন। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে আর্যরা ভারতবর্ষে আসার পূর্বে শিব ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধানতম অনার্য দেবতা। একইভাবে, প্রাচীন বাংলাতেও আর্যরা আসার পূর্বে শিব ছিলেন প্রধানতম অনার্য দেবতা। যে কারণে প্রকৃতিকে দেবী কল্পনা করলেও শিব এর গুরুত্ব কখনওই হ্রাস পায়নি। আজও …
সে যাই হোক। বাঙালিসমাজে পরবর্তীকালে দেবী ধারণার স্বতঃস্ফূর্ত বিবর্তন দেখতে পাই, যে দেবী ধারণার উন্মেষ ঘটেছিল সুপ্রাচীন বাংলায় নিষাদদের মাতৃতান্ত্রিক ধর্মীয় ভাবনায়। এই দেবী বাঙালিসমাজে ‘শক্তি’ দেবী নামে পরিচিতা। যারা শক্তি দেবীর উপাসনা করেন তারাই ‘শাক্ত’ বলে পরিচিত।ধর্মতত্ত্বের ভাষায়: শাক্ত-তান্ত্রিক। শক্তিদেবী অবশ্য বাঙালিসমাজে আরও নানা নামে পরিচিতা। যেমন: কালী, কামেশ্বরী, ভীমাদেবী, জগদ্বাত্রী, গন্ধেশ্বরী, অন্নপূর্ণা, বাসুলি, বিপদনাশিনী, সন্তোষীমাতা এবং দূর্গা।
এই যে প্রকৃতিকে দেবীরূপে ভজনা- এই বিশ্বাস, সাধনা, দর্শন ও আরাধনার সমস্ত প্রক্রিয়াকে আমরা একত্রে বলতে পারি- ‘তন্ত্র’। যে তান্ত্রিক বিশ্বাসের উন্মেষ হয়েছিল নিষাদদের ধর্মীয় চেতনায় । কাজেই তন্ত্রের উদ্ভব প্রাচীন বাংলায়। ( দেখুন; তন্ত্র: দুলাল ভৌমিক। বাংলাপিডিয়া)
আলোচনার এ পর্যায়ে এবার একবার মূল প্রশ্নে ফিরে যাওয়া যাক। পূজা কাকে করা হয়? এবং কেন করা হয়? পূজা করা হয় ‘চৈতন্যময়ী’ প্রকৃতিকে। কেন করা হয়? চৈতন্যময়ী প্রকৃতিকে তুষ্ঠ করতেই পূজা করা হয়; যাতে পূজারী/ভক্তের জীবন আনন্দময়, কল্যাণময় হয়ে ওঠে। তন্ত্র হচ্ছে দর্শন বা তত্ত্ব। আর পূজা হচ্ছে পদ্ধতি। পূজার উপচার বা উপকরণ নিষাদরা তাদের নিজস্ব পরিবেশ থেকেই সংগ্রহ করেছিল। পরবর্তীকালে বাংলায় তাদের এই ধারণার (প্রকৃতি কে ‘চৈতন্যময়ী’ বলে মনে করে দেবীরূপে ভজনা করা) বিবর্তিত হয়েছিল। এবং এই নারীকেন্দ্রিক তান্ত্রিক ধারণাটি পল্লবিত হয়েছিল। তন্ত্র সর্ম্পকে একটি ইউরোপিয় সূত্র লিখেছে,
The word “tantra” is derived from the combination of two words “tattva” and “mantra”. “Tattva” means the science of cosmic principles, while “mantra” refers to the science of mystic sound and vibrations. Tantra therefore is the application of cosmic sciences with a view to attain spiritual ascendancy. In another sense, tantra also means the scripture by which the light of knowledge is spread .
তন্ত্রের প্রধান একটি সিদ্ধান্তই হল এই যে প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী মনে করা। কিন্তু, শক্তি কি? বিশ্বজগতে সবই তো শক্তির সমাহার। যে শক্তিকে বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। আধুনিক সভ্যতা এই মূলতত্ত্বের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতির সূত্র আবিস্কার করে এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা কতটা যৌক্তিক এই প্রশ্নও তো আজকাল উঠছে । এই দৃষ্টিভঙ্গি হটকারী কিনা, পরিবেশ বিপর্যয়ের মূলে এই দর্শন সক্রিয় কিনা- এসব প্রশ্নও নিয়েও তো আমরা আজ উদ্বিগ্ন।
তো, প্রাকৃতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে তন্ত্রের সিদ্ধান্ত কি?
তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না। তার কারণ, তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী জেনেছে, মা বলে জেনেছে, মায়ের দেবীপ্রতিমা কল্পনা করেছে; দেবী মা (প্রাকৃতি কে) কে একজন তান্ত্রিক নিষ্ঠাভরে ভজনা করতে চায়, আরাধনা করতে চায়, পূজা করতে চায়। পাশাপাশি একজন তান্ত্রিক মনে করেন, একজন ভক্ত চৈতন্যময়ী শক্তির অনুগত থাকলে চৈতন্যময়ী শক্তির কৃপায় তার অশেষ কল্যাণ সাধিত হতে পারে।
এই হল বিজ্ঞান এবং তন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য।
চৈতন্যময়ী প্রকৃতিরূপী নারীবাদী তন্ত্রের দেবী দূর্গা- কালী- বাসুলী – তারা- শিবানী। কিন্তু তন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছেন (আমি আগেই একবার ইঙ্গিত দিয়েছি) অনার্য দেবতা শিব। তন্ত্রমতে শিব তাঁর শক্তি পেয়েছে কালীর কাছ থেকে। আবার শিব- এর রয়েছে পৃথক নিজস্ব শক্তি। তন্ত্রমতে পুরুষ শক্তিলাভ করে নারীশক্তি থেকে। শিব শক্তি লাভ করেছেন তাঁর নারীশক্তির প্রকাশ- গৌড়ীর শক্তি থেকে। তবে শিবের নিজস্ব শক্তিও স্বীকৃত। তন্ত্রসাধনার মূল উদ্দেশ্যই হল- (প্রাকৃতিক) শক্তি দেবীর সাধনা করে “শিবত্ব” লাভ তথা শক্তিমান হওয়া।
এখানেই বলে রাখি যে- প্রাচীন ও মধ্যযুগের বঙ্গবাসী পরবর্তীকালে নগর গড়ে তুললেও সে তার আদিম পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য কখনও পরিত্যাগ করেনি কিংবা বিস্মৃত হয়নি। এই বাঙালি মননের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নগরেও পূজা হয়েছে। উপচার হল পূজার উপকরণ। এমন কী, পূজার উপচারেও দেখা যায় নিষাদ উপকরণ। আপত চাল, তিল, জল, দুধ, কুশাগ্র, দই, যব, শ্বেতসরিষা, চন্দন, বিল্বপত্র বা বেলপাতা, কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, ডালিম, বেল, অশোক, মানকচু, ধান, কলাগাছ, গম, মাষকলাই, তিসি। এ সবই প্রাচীন বাংলার লোকজসমাজের কৃষিপণ্য।
এখানেই বলে রাখি যে প্রাচীন বাংলার নিষাদসমাজের তান্ত্রিক বিশ্বাস ও বাহিরাগত (আর্যরা প্রাচীন বাংলার বাইরে থেকে এসেছিল বলে) আর্যবৈদিক মতের কিছু পার্থক্য রয়েছে। বহিরাগত আর্যদের বৈদিক ধর্মবিশ্বাসটি মূলত পুরুষতান্ত্রিক; পক্ষান্তরে বাংলার অনার্যদের তান্ত্রিক মত মাতৃতান্ত্রিক। তা ছাড়া
আর্যদের বৈদিক মত হল ঋষিজ: তার মানে দার্শনিক বা ফিলোফফিক্যাল। এ কারণে মানবকল্যাণে এর ভূমিকা প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। অন্যদিকে তান্ত্রিকমত মুণিজ বা বিজ্ঞান ভিত্তিক হওয়ায় জগৎসংসারে জীবজগতে এর প্রভাব প্রত্যক্ষ। সনাতনধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিধান্ত হল- দর্শনের সামগ্রিক দৃষ্টি এবং তন্ত্রমতের খন্ডিত বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি একত্রিত হলেই জ্ঞান সম্পূর্ণ হয়। এ কারণেই বেদের যজ্ঞ এবং তন্ত্রের পূজা সম্মিলিত ভাবে সনাতনধর্মকে একটি দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে। (দেখুন;রণজিৎ কর; সনাতনধর্ম: মত ও মতান্তর।)
তন্ত্র থেকে তত্ত্ব। তন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বা উদ্দেশ্য হল তত্ত্বের সিদ্ধান্তকে জীবনের কর্মক্ষেত্রে রূপদান করা। কাজেই তন্ত্রের প্রচারের মাধ্যম আচরণ বা থিউরি নয়, প্র্যাকটিস। তন্ত্রমতে নারী জগতের আদি কারণ। তন্ত্রের উদ্ভব প্রাচীন বাংলার মাতৃতান্ত্রিক নিষাদসমাজে হয়েছিল বলেই এমনটাই ভাবা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল।
কিন্তু, তন্ত্রমতে কেন নারী জগতের আদি কারণ?
ঈশ্বর নিরাকার। রূপহীন। যে কারণে প্রাচীন বৈদিক আর্যরা ঈশ্বরের রূপ বর্ণনা করেছেন এভাবে-
‘রূপংরূপ বিবর্জিতস্য ভবতো ধ্যানেন যদবর্ণিতং।’
এর মানে হল- ‘হে রূপহীন ঈশ্বর! ধ্যানে তোমার রূপ বর্ণনা করেছি।’
তন্ত্রমতে নারী জগতের আদি কারণ এই জন্য যে এই নিরাকার রূপহীন ইশ্বরকে যখন নারী ভাবা হয় তখন ঈশ্বরের মাহাত্ম ক্ষুন্ন হয় না। কাজেই ভক্তের মানসিক প্রবনার ওপরই মাতৃমূর্তির কল্পনা। যে কারণে বলা হয়েছে -
‘সাধকানাং হিতার্থায়ৈ ব্রহ্মণে রূপকল্পনা’
এর মানে হল- ‘সাধকের হিতের জন্য ঈশ্বরের রূপ কল্পনা করা হয়েছে।’
সুপ্রাচীন বাংলার গুরুত্বপূর্ন এক অনার্য ধর্মীয় বিশ্বাস হল- যোগ ( যাকে আমরা ইয়োগা বলে জানি)। পূজার সঙ্গে যোগ-এর অত্যন্ত ঘনিষ্ট সর্ম্পক রয়েছে। এই বিষয়টিও আমাদের জানতে হবে। নইলে পূজা কেন করা হয়, এবং কাকে করা হয় এসব নিগুঢ় বিষয় পরিস্কার হবে না ।
আমরা জেনেছি যে তন্ত্র নারীবাদী হলেও এর কেন্দ্রে রয়েছেন শিব ; যিনি প্রধানতম অনার্য দেবতা। এবং তন্ত্রে নারীকে জগতের আদিকারণ মনে করা হলেও বিশ্বপ্রকৃতির সমস্ত শক্তির উৎস হলেন শিব। আর এই কারণেই তো, কাজী নজরুল ইসলাম আহিরি ভৈরব রাগে রচিত তাঁর বিখ্যাত ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি’ গানটিতে শিব কে ‘ত্রিভূনের পতি’ বলে উল্লেখ করেছেন-
‘নবমেঘ চন্দনে ঢাকি অঙ্গজ্যোতি/
প্রিয় হয়ে দেখা দাও ত্রিভূবন পতি
বিষাণ ফেলিয়া হও বাঁশরীধারী …
উত্তর ভারতে শিব সম্বন্ধে বলা হয়েছে-‘সত্যম’,‘শিবম’,‘সুন্দরম’। এ সমস্ত কারণে যোগ- এর উদ্দেশ্যই হল ‘শিবত্ব’ অর্জন। মধ্যযুগের বাংলায় চন্দ্রদ্বীপবাসী (বরিশালের) মীননাথ শিবপন্থি নাথধর্ম প্রচার করেছিলেন । মীননাথ-এর শিষ্যদের বলা হয় নাথযোগী। নাথযোগীরা সাহিত্যকে আশ্রয় করে তাদের ধর্ম-দর্শন প্রচার করেছিলেন। এদের লেখা কাব্য বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রতœ বলে বিবেচিত। নাথযোগীদের লেখা ‘গোরক্ষ বিজয়’-এ লেখা রয়েছে-
‘মুন্ডে আর হাড়ে তুমি কেনে পৈর মালা
ঝলমল করে গায়ে ভস্ম ঝুলি ছালা।
পুনরপি যোগী হৈব কর্ণে কড়ি দিয়া।’
এই চারটি চরণে আসলে একজন যোগীর ছবিই আঁকা হয়েছে। যোগীর ছবিটি আসলে অনার্য শিবেরই ছবি। এবং কড়ি জিনিসটা অস্ট্রিকভাষী নিষাদ/ কিরাতের উপচার (উপকরণ)। এবার তাহলে বলি যোগ- এর সঙ্গে চৈতন্যময়ী মা-প্রকৃতির কী সর্ম্পক। যোগীগণ শরীরের চৈতন্যকেই প্রাণশক্তি বা আত্মা বলে মনে করতেন। দেহের বাইরে চৈতন্য যেহেতু সম্ভবপর নয়; সুতরাং, শরীর সম্বন্ধেই অনার্য যোগীঋষিরা সুপ্রাচীনকালে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। (পাঠক, এই সুপ্রাচীন ভাবনাকে বাউল দর্শনেরও ভিত্তি বলে মনে করতে পারেন কিন্তু) দেহকে বোঝা ও একে নিয়ন্ত্রন করে ইচ্ছে মতন পরিচালিত করা যোগসাধনার অন্যতম লক্ষ্য। ‘কায়া’ মানে শরীর। ‘কায়সাধন’ মানে শরীরের সাধনা।‘ কায়সাধন অতি প্রাচীন দেশী শাস্ত্র, তত্ত্ব ও পদ্ধতি।’(বাঙলা বাঙালি ও বাঙালীত্ব: আহমদ শরীফ; পৃষ্ঠা ৪৩) এ ছাড়া শরীর বিষয়ক বাঙালির ধর্মতত্ত্বের একটি বড় সিদ্ধান্ত এই -
‘ব্রহ্মান্ডে য গুণাঃ সন্তি তে তিষ্টন্তি কলেবরে’।
এর মানে, ‘যা আছে ভান্ডে (মানে শরীরে/মানবদেহে) তাই আছে বিশ্বভ্রহ্মান্ডে বা ইউনিভার্সে ।’ ড.আহমদ শরীফ একবার মন্তব্য করেছিলেন: ‘বাঙালির ধর্মতত্ত্বে পাপ-পুন্যের কথা বেশি নেই। অনেক বেশি রয়েছে জীবন রহস্য জানবার বুঝবার প্রয়াস।’ (বাঙলা বাঙালি ও বাঙালীত্ব: আহমদ শরীফ পৃষ্ঠা; ৪৮) পন্ডিতের এ কথা একালেও যেমন সত্য সেই আদিম নিষাদ-যুগেও সত্য।
… বলেছিলাম তন্ত্রের একটি বিরাট সিদ্ধান্ত হল শক্তিকে চৈতন্যময়ী মনে করা। সেই চৈতন্যময়ী শক্তি কি কেবল প্রকৃতিতেই বিরাজ করে?
না। চৈতন্যময়ী শক্তি সর্বত্র বিরাজমান।
মানবদেহে?
অবশ্যই।
প্রাচীন বাংলার বাঙালি যোগীগণ শরীরের ভিতর যে চৈতন্যকেই প্রাণশক্তি বা আত্মা মনে করেন তিনিই সেই চৈতন্যময়ী । এই মানবচৈতন্য সেই শক্তিরই এক রূপ। দেহের বাইরে চৈতন্য সম্ভব নয় বলেই জীবন রহস্য জানবার বুঝবার প্রয়াস প্রাচীন বাংলার বাঙালি যোগীগণ শরীর সম্বন্ধে কৌতূহলী হয়েছে এবং এভাবে সুপ্রাচীন কালেই বাউল দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। ছান্দোগ্য উপনিষদেও এর সমর্থন
‘এই পৃথিবীতে দেহেরই পূজা করিবে, দেহেরই পরিচর্যা করিবে। দেহকে মহীয়ান করিলে এবং দেহের পরিচর্যা করিলেই ইহলোক ও পরলোক-এই উভয়লোকই লাভ করা যায়। (বিরোচন। ৮/৮/৪)
এবার বলি তন্ত্রমতে পূজার আধার ১১ টি। এসব আধার পূজারীর দেহের সঙ্গে সর্ম্পকযুক্ত। দেবীপ্রতিমা, প্রজ্জ্বলিত অগ্নি, পাত্রস্থিত জল, চিহ্নিত যন্ত্র, মন্দির পরিচায়ক ছবি অংকিত বিশেষ চিহ্ন (সাত্ত্বিক চিহ্ন, ঔঁ কার চিহ্ন) মস্তক শিরোদেশ এবং পূজারীর হৃদয়।
পূজায় দুটি বিষয় রয়েছে। এক মন্ত্র ও উপচার। একটি অন্তরের দিক ও অন্যটি বাহ্যিক দিক। মন্ত্র অন্তরের দিক, উপচার বাহ্যিক দিক। উপচার হল পূজার উপকরণ। আশ্চর্য এই যে -পূজার উপচারও দেহের সঙ্গে গভীরভাবে সর্ম্পকিত। পূজায় প্রধান হল পঞ্চোপচার। যেমন সুগন্ধ দ্রব্য, পানীয়, প্রদীপ, পাখার বাতাস ও ফুল। এসবের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য। আসলে পঞ্চোপচার হল পূজারী দেহের প্রাণের মনের বেদনের ও অহং এর প্রতীক যা দেবীর নিকট নিবেদন করা হয়। এর মানে পূজারী তার বস্তুময় জীবনক্ষেত্র, প্রাণময় জীবনক্ষেত্র, মনোময় জীবনক্ষেত্র, বোধময় জীবনক্ষেত্র এবং আনন্দময় জীবনক্ষেত্র প্রতীক হিসেবে দেবীর কাছে নিবেদন করলেন। এর নামই আত্ম নিবেদন। এভাবে উপাসক মানুষ তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করল।
এ পোস্টের গোড়ায় এই দুটি প্রশ্ন ছিল যে পূজা কাকে করা হয়? পূজা কেন করা হয়?
বাঙালি হিন্দু তান্ত্রিক বলেই পূজা করে; বাঙালি হিন্দুর ঐতিহ্যে যোগসাধনার ভূমিকা রয়েছে বলেই তারা পূজা করে। বাঙালি হিন্দু তান্ত্রিক বলেই প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী মনে করে। এবং সেই চৈতন্যময়ী শক্তিকে বাঙালি হিন্দুর মানবীয় উপলব্দির সীমানায় নিয়ে এসে সেই চৈতন্যময়ী শক্তির সঙ্গে মাতাপিতার সর্ম্পক স্থাপন করে, সেই চৈতন্যময়ী শক্তিকে দেবীরূপে কল্পনা করে পূজা করে। অষ্ট্রিক ভাষার শব্দ ‘পূজা’ অর্থ-শ্রদ্ধা …
এই পোস্টটির তথ্যের উৎস:
আহমদ শরীফ; বাঙলা বাঙালি ও বাঙালীত্ব।
নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য; ধর্ম ও সংস্কৃতি; প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট
ড. এম আর দেবনাথ; সিন্ধু থেকে হিন্দু ।
রণজিৎ কর; সনাতনধর্ম: মত ও মতান্তর।
অমর সাহিত্যঃ মহা ভারত
14জু
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন একটি সাহিত্যকর্ম হিসাবে মহা ভারত পৃথিবী বিখ্যাত। একটা সাহিত্য কর্ম মানুষের উপর কতটা প্রভাব ফেললে সেটা ধর্ম গ্রন্থে পরিনত হয় তার একটি জলন্ত প্রমান এই মহা ভারত। আজ এই অমর সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
মহাভারত (সংস্কৃত: महाभारत) সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীন ভারতের দুটি প্রধান মহাকাব্যের অন্যতম (অপরটি হল রামায়ণ)। এই মহাকাব্যটি হিন্দুশাস্ত্রের ইতিহাস অংশের অন্তর্গত।
মহাভারত-এর মূল উপজীব্য বিষয় হল কৌরব ও পাণ্ডবদের গৃহবিবাদ এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাবলি। তবে এই আখ্যানভাগের বাইরেও দর্শন ও ভক্তির অধিকাংশ উপাদানই এই মহাকাব্যে সংযোজিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ – এই চার পুরুষার্থ-সংক্রান্ত একটি আলোচনা (১২।১৬১) সংযোজিত হয়েছে এই গ্রন্থে। মহাভারত-এর অন্তর্গত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা ও উপাখ্যানগুলি হল ভগবদ্গীতা, দময়ন্তীর উপাখ্যান, রামায়ণ-এর একটি সংক্ষিপ্ত পাঠান্তর ইত্যাদি। এগুলিকে মহাভারত-রচয়িতার নিজস্ব সৃষ্টি বলে মনে করা হয়।
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, মহাভারত-এর রচয়িতা ব্যাসদেব। অনেক গবেষক এই মহাকাব্যের ঐতিহাসিক বিকাশ ও রচনাকালীন স্তরগুলি নিয়ে গবেষণা করেছেন। অধুনা প্রাপ্ত পাঠটির প্রাচীনতম অংশটি মোটামুটি ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ রচিত হয়। মহাভারতের মূলপাঠটি তার বর্তমান রূপটি পরিগ্রহ করে গুপ্তযুগের প্রথমাংশে (খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী)। মহাভারত কথাটির অর্থ হল ভরত বংশের মহান উপাখ্যান। গ্রন্থেই উল্লিখিত হয়েছে যে ভারত নামে ২৪,০০০ শ্লোকবিশিষ্ট একটি ক্ষুদ্রতর আখ্যান থেকে মহাভারত মহাকাব্যের কাহিনিটি বিস্তার লাভ করে।
মহাভারত-এ এক লক্ষ শ্লোক ও দীর্ঘ গদ্যাংশ রয়েছে। এই মহাকাব্যের শব্দসংখ্যা প্রায় আঠারো লক্ষ। মহাভারত মহাকাব্যটির আয়তন ইলিয়াড ও ওডিসি কাব্যদ্বয়ের সম্মিলিত আয়তনের দশগুণ এবং রামায়ণ-এর চারগুণ।
রচনার ইতিহাস ও গঠনঃ
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, ব্যাসদেব এই মহাকাব্যের রচয়িতা। তিনি এই আখ্যানকাব্যের অন্যতম চরিত্রও বটে। মহাভারত-এর প্রথম অংশের বর্ণনা অনুযায়ী, ব্যাসদেবের অনুরোধে তাঁর নির্দেশনা মতো গণেশ এই মহাকাব্য লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব নেন। গণেশ একটি শর্তে এই কাজে রাজি হয়েছিলেন। তাঁর শর্ত ছিল ব্যাস একবারও না থেমে সমগ্র মহাকাব্যটি আবৃত্তি করবেন। ব্যাস রাজি হন, কিন্তু তিনিও পাল্টা শর্ত দেন যে গণেশও প্রতিটি শ্লোকের অর্থ না বুঝে লিপিবদ্ধ করতে পারবেন না।
মহাভারত মহাকাব্যটি গল্পের মধ্য গল্প শৈলীতে রচিত। এই শৈলী ভারতের অনেক ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ রচনার বৈশিষ্ট্য। অর্জুনের প্রপৌত্র জনমেজয়ের নিকট এই কাহিনি পাঠ করে শোনান ব্যাসদেবের শিষ্য বৈশম্পায়ন। অনেক বছর পরে, জনমেজয়ের নিকট বৈশম্পায়নের এই মহাভারত কথনের ঘটনাটি পেশাদার কথক উগ্রশ্রবা সৌতি কর্তৃক ঋষিদের একটি যজ্ঞসমাবেশে কথিত হয়।
সংক্ষিপ্ত কাহিনিঃ
কাহিনীর শুরু প্রকৃতপক্ষে ভরত রাজার সময় থেকে। কিন্তু বহু পুস্তকে রাজা শান্তনুর সময় থেকে কাহিনী শুরু করা হয়। পিতৃসত্য পালনের জন্য শান্তনুর পুত্র দেবব্রত আজীবন বিবাহ করেন নি ও রাজসিংহাসনে বসেন নি। এই ভীষণ প্রতিজ্ঞান জন্য তাঁকে ভীষ্ম বলা হয়। ভীষ্মের কণিষ্ঠ ভ্রাতা বিচিত্রবীর্য রাজত্ব চালান তাঁর ছিল দুই পুত্র – ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ হওয়ায় পাণ্ডু রাজা হন। কিন্তু পাণ্ডুর অকালমৃত্যুর পর রাজত্ব ধৃতরাষ্ট্রের তত্বাবধানে আসে। সেখান থেকেই শুরু হয় মহাভারতের মহাবিরোধ। কে রাজা হবেন – পাণ্ডুর পুত্র, না ধৃতরাষ্ট্রের ? শুরু হয় হিংসা, ষড়যন্ত্র, কপট দ্যূতক্রীড়া বনবাস ইত্যাদি । কাহিনীর পরিণতি অষ্টাদশদিবসব্যাপী এক সংহারক যুদ্ধ – যাতে ভারতবর্ষের বহু রাজার প্রাণ যায় । মৃত্যু হয় ধৃতরাষ্টের জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধন সহ মোট শতপুত্রের। শেষে রাজত্ব পান জ্যেষ্ঠ পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির। সমস্ত কাহিনীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মুখ্য চালকের ভূমিকায় থাকেন। এই কাহিনীর আধ্যাত্মিক সারাংশ হল ধর্মের জয় ও অধর্মের নাশ।
চরিত্র সমূহঃ
পাণ্ডব শিবিরঃ পঞ্চপাণ্ডব (যুথিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব), এদের মা কুন্তি (বাবা পাণ্ডু যুদ্ধের বহু পূর্বে বিগত, নকুল, সহদেব-এর মা মাদ্রী সহমৃতা।) স্ত্রী দ্রৌপদী। পুত্র অভিমন্যু, ঘটোত্কচ, শিখণ্ডী, কৃষ্ণ
কৌরব শিবিরঃ দূর্যোধন, দুঃশাসন ইত্যাদি ভাইরা, (পিতা ধৃতরাষ্ট্র রাজধানীতে থেকে সঞ্জয়ের মুখে বর্ণনা শুনছিলেন ও মন্ত্রী বিদুরের সহাতায় রাজ্য চালনা করছিলেন, সেখানে আরো ছিলেন এদের বোন দুঃশলা, মা গান্ধারী), মামা শকুনি। পিতামহ ভীষ্ম, গুরু দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, কর্ণ, অশ্বথামা, শল্য।
অর্জুন
08জু
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে এই নামে একাধিক চরিত্র পাওয়া যায়। যেমন–
১. মাহিষ্মতী পুরীতে অর্জুন নামক একজন রাজা ছিলেন। এঁর পিতার নাম ছিল কৃর্তবীর্য। এই কারণে ইনি কার্তবীর্য বা কার্তবীর্যার্জুন নামে পরিচিত ছিলেন।
২. মহাভারতের অন্যতম চরিত্র। এঁর অপরাপর নাম– অরিমর্দন, কপিকেতন, কপিধ্বজ, কিরীটী, কৃষ্ণসখ, কৃষ্ণসারথি, কৌন্তেয়, গাণ্ডিবধন্বা, গাণ্ডিবী, গুড়াকেশ, চিত্রযোধী, জিষ্ণু, তৃতীয় পাণ্ডব, ধনঞ্জয়, পার্থ, ফল্গুন, ফাল্গুনি, বিজয়, বীভৎসু, শব্দবেধী, শব্দভেদী, শুভ্র, শ্বেতবাহ, শ্বেতবাহন, সব্যসাচী।
পাণ্ডু নামক রাজা কিমিন্দম মুনির অভিশাপের (যে কোন নারীর সাথে সঙ্গম করতে গেলে– পাণ্ডু মৃত্যুবরণ করবেন) কারণে স্ত্রীসংগম থেকে বিরত থাকেন। এই কারণে ইনি তাঁর স্ত্রীদ্বয়ের গর্ভে সন্তান লাভ করতে পারলেন না। এরপর ইনি তাঁর স্ত্রী কুন্তী’কে ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদনের জন্য অন্য পুরুষকে গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। কুন্তী সন্তান কামনায় তিনবার তিনজন দেবতাকে আহ্বান করেছিলেন। শেষবারে তিনি দেবরাজ ইন্দ্রকে আহ্বান করেন। এর ফলে ইন্দ্রের ঔরসে তিনি অর্জুনকে জন্ম দেন। উল্লেখ্য এঁর পূর্বে একই ভাবে কুন্তী পাণ্ডুর অনুরোধে আরও দুটি সন্তান লাভ করেছিলেন। এরা হলেন- ধর্মের ঔরসে যুধিষ্ঠির ও পবনের ঔরসে ভীম। সেই কারণে অর্জুন তৃতীয় পাণ্ডব নামে পরিচিত হয়ে থাকেন। অবশ্য তবে তারও আগে অবিবাহিতা অবস্থায় সূর্যের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে জন্মেছিল কর্ণ। কিন্তু তখন তিনি পাণ্ডুর স্ত্রী ছিলেন না বলে- কর্ণ পাণ্ডব হিসাবে স্বীকৃতি পান নি।
অর্জুন প্রথমে কৃপাচার্যের কাছে, পরে দ্রৌণাচার্যের কাছে অন্যান্য পাণ্ডব ও ধৃতরাষ্ট্রের সন্তানদের সাথে অস্ত্রবিদ্যা ও যুদ্ধনীতি শিক্ষা করেন। ইনি দ্রৌণাচার্যের সকল শিষ্যদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। কথিত আছে দ্রৌণাচার্য তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা এবং অর্জুনকে বিশেষ যত্নের সাথে অস্ত্রশিক্ষা দান করছিলেন। ধনুর্বিদ্যায় সমকালীন সকল বীরদের মধ্যে ইনি শ্রেষ্ঠ ছিলেন। কৌরবসভায় অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শনকালে দ্রৌণাচার্য সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ব্রহ্মশির নামক অমোঘ অস্ত্র দান করেন। গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণকে পরাজিত করে- তাঁর কাছ থেকে তিনি চাক্ষুষী বিদ্যা (যার প্রভাবে যে কোন অদৃশ্য বস্তুকে দেখা সম্ভব হতো) লাভ করেন।
দ্রুপদ-কন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরসভায় অন্যান্য পাণ্ডবদের সাথে ছদ্মবেশে ইনি উপস্থিত হন। এই সভায় একমাত্র তিনিই চক্রমধ্য-মৎস্যকে বিদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে সূত্রে ইনি দ্রৌপদীকে লাভ করেন। কিন্তু মাতৃ-আজ্ঞায় পঞ্চপাণ্ডব একত্রে তাঁকে বিবাহ করেন। দ্রৌপদীকে নিয়ে যাতে ভ্রাতৃবিরোধ না ঘটে, সে কারণে- নারদ নিয়ম করে দেন যে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, দ্রৌপদী একজন মাত্র পাণ্ডবের স্ত্রী হিসাবে থাকবেন। এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অধীকারপ্রাপ্ত পাণ্ডব ব্যতীত অন্য কোন পাণ্ডব দ্রৌপদীকে গ্রহণ করলে বা দ্রৌপদীর সাথে অধিকারপ্রাপ্ত পাণ্ডবের বিহারকালে অন্য পাণ্ডব দর্শন করলে- তাঁকে ১২ বৎসর বনবাসী থাকতে হবে। ঘটনাক্রমে একবার এক ব্রাহ্মণকে সাহায্য করার জন্য- অর্জুন অস্ত্রাগারে প্রবেশ করলে- সেখানে যুধিষ্ঠিরের সাথে দ্রৌপদীকে এক শয্যায় দেখতে পান। এই কারণে ইনি ১২ বৎসর বনবাসের জন্য গৃহত্যাগ করেন। বনবাসকালে ইনি বিভিন্নস্থানে ভ্রমণ করে বেড়ান। এই সময়ে ইনি পরশুরামের সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং তাঁর কাছ থেকে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেন। এই ভ্রমণকালে ইনি নাগকন্যা উলূপী ও মণিপুর-রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করেন। তাঁর ঔরসে উলূপীর গর্ভে ইরাবান এবং চিত্রাঙ্গদার গর্ভে বভ্রুবাহনের জন্ম হয়।
এরপর অর্জুন দক্ষিণসাগরের দিকে যাত্রা করেন, পঞ্চতীর্থকে কুমীরমুক্ত করেন। উল্লেখ্য এই তীর্থে অভিশপ্ত অপ্সরা বর্গা ও তাঁর চার সখী কুমিররূপে থাকতেন। অর্জুনের স্পর্শে তাঁরা অভিশাপমুক্ত হন। এরপর অর্জুন দ্বারকায় এলে শ্রীকৃষ্ণের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। সেখানে শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে ও সহায়তায় তাঁর বোন সুভদ্রাকে হরণ করে অর্জুন বিবাহ করেন। সুভদ্রার গর্ভে তাঁর অভিমন্যু নামে একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করে। ১২ বৎসর পর পুনরায় পাণ্ডবদের সাথে ইনি মিলিত হন। এই সময় দ্রৌপদীর সাথে মিলিত হলে, শ্রুতকর্মা নামক একটি পুত্রসন্তান জন্মে।
এই সময় একদিন অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণ যমুনাতীরে ভ্রমণ করার সময় অগ্নি এসে খাণ্ডববন দগ্ধ করার জন্য অর্জুনের সাহায্য প্রার্থনা করেন। অর্জুন তাকে সাহায্য করতে রাজি হলেন। কিন্তু একই সাথে জানালেন যে, উক্ত বন দগ্ধ করতে গেলে দেবতাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। এবং আরও বললেন যে, দেবতাদের সাথে যুদ্ধ করতে গেলে যে ধরনের অস্ত্র প্রয়োজন, সে ধরনের অস্ত্র তাঁর কাছে নেই। অগ্নিদেব তখন তাঁর সখা বরুণকে অনুরোধ করে– তাঁর কাছ থেকে গাণ্ডীবধনু, অক্ষয় তূণীদ্বয় ও কপিধ্বজা রথ এনে দিলেন। এই সকল অস্ত্রের সাহায্যে কৃষ্ণ ও অর্জুন দেবতাদের পরাস্ত করেন। পরে শর নিক্ষেপে অর্জুন খাণ্ডববন দগ্ধ করেন।
এরপর অক্ষক্রীড়ায় যুধিষ্ঠির রাজ্যচ্যুত হলে, অন্যান্য ভাইদের সাথে ইনি ১৩ বৎসরের জন্য বনবাসে যান। এই সময়ে কিরাতবেশী মহাদেব-এর সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মহাদেব সন্তুষ্ট হয়ে অর্জুনকে পাশুপাত অস্ত্র প্রদান করেন। এরপর ইন্দ্র, বরুণ, কুবের ও যমের সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠ অস্ত্রসমূহ লাভ করেন। এরপর তাঁর পিতা ইন্দ্র তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যান। সেখানে ইনি গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের কাছে নৃত্যগীতি শিক্ষা করেন। স্বর্গবাসকালে উর্বশী তাঁকে প্রেম নিবেদন করলে- ইনি তাঁকে মাতৃজ্ঞানে প্রত্যাখ্যান করেন। এই কারণে, উর্বশী তাঁকে এক বৎসর নপুংসক অবস্থায় অতিবাহিত হওয়ার অভিশাপ দেন। এরপর ইনি ইন্দ্রের কাছে অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত করেন। শিক্ষা শেষে ইনি গুরুদক্ষিণা বাবদ- ইন্দ্রের শত্রু নিবাতকবচ নামক তিন কোটি দানবকে তাদের সমুদ্র মধ্যস্থ দুর্গসহ ধ্বংস করেন এবং পৌলম ও কালকেয় অসুরদের বিনাশ করেন। এই কারণে ইন্দ্র সন্তুষ্ট হয়ে- তাঁকে অভেদ্য দিব্যকবচ, হিরণ্ময়ী মালা, দেবদত্ত শঙ্খ, দিব্যকিরীট, দিব্যবস্ত্র ও ভরণ উপহার দেন। পাঁচ বৎসর ইন্দ্রলোকে থাকার পর ইনি বনে এসে ভাইদের সাথে যোগ দেন।
এরপর দ্বৈতবনে থাকাকালে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন দুর্যোধনকে বন্দী করেন। এই কারণে চিত্রসেনের সাথে অর্জুনের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে অর্জুন চিত্রসেনকে পরাজিত করে দুর্যোধনকে উদ্ধার করেন।
সিন্ধুরাজ দ্রৌপদীকে হরণ করলে, অর্জুন ও ভীম মিলে তাঁকে শাস্তি দেন। এরপর এঁরা মৎস্যরাজ বিরাট-ভবনে উপস্থিত হন। সেখানে উর্বশীর শাপে অর্জুন নপংশুক হয়ে বৃহন্নলা নাম ধারণ করেন। এই বেশে বিরাট-কন্যা উত্তরাকে ইনি নৃত্যগীত শেখানোর দায়িত্ব গ্রহণ করে এক বৎসর অতিবাহিত করেন। পাণ্ডবদের এই অজ্ঞাতবাসের শেষাংশে দুর্যোধন বিরাটরাজের গোধন হরণ করলে বৃহন্নলারূপী অর্জুন কৌরব-সৈন্যদের পরাস্ত করে গোধন উদ্ধার করেন। যুদ্ধ শেষে বিরাটরাজ অর্জুনের সাথে উত্তরার বিবাহ ঠিক করেন। কিন্তু শিষ্যা কন্যার মত বলে ইনি নিজ পুত্র অভিমন্যুর সাথে উত্তরার বিবাহ দেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ইনি কৃষ্ণকে উপদেষ্টা ও তাঁর রথের সারথি হিসাবে লাভ করেন। এরপর অর্জুন স্বজনবধে বিমুখ হলে- কৃষ্ণ তাঁকে উপদেশ দিয়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করেন। এই উপদেশসমূহের সংকলনই হলো- শ্রীমদ্ভগভদ্গীতা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ইনি অসংখ্য কৌরব-সৈন্যকে হত্যা করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দশম দিনে এঁর শরাঘাতে ভীষ্ম শরশয্যা গ্রহণ করে- ইচ্ছামৃত্য গ্রহণ করেন। এছাড়া যুদ্ধের দ্বাদশ দিনে ভগদত্তকে, চতুর্দশ দিনে অভিমন্যু বধের প্রতিজ্ঞা স্বরূপ জয়দ্রুতকে, পঞ্চদশ দিনে দ্রোণাচার্যকে, ষোড়শ দিনে মগধরাজ দণ্ডধারকে ও সপ্তদশ দিনে কর্ণকে হত্যা করেন।
যুদ্ধজয়ের পর যুধিষ্ঠির অশ্বমেধযজ্ঞের আয়োজন করেন। যজ্ঞের অশ্ব রক্ষার জন্য অর্জুন যাত্রা করে ত্রিগর্ত, প্রাগ্জ্যোতিষপুর ও সিন্ধুদেশ জয় করেন। মণিপুরে নিজপুত্র বভ্রুবাহনের সাথে যুদ্ধে ইনি প্রাণ হারালে– অর্জুনের স্ত্রী নাগকন্যা উলূপী নাগলোক থেকে সঞ্জীবনী এনে তাঁকে জীবিত করে তোলেন। এরপর ইনি অশ্বসহ স্বরাজ্যে ফিরে সেন। এরপর শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু ও যাদবকুলের বিনাশের সংবাদ পেয়ে ইনি দ্বারকায় যান। অর্জুন সেখানকার নারীদের নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে আসার সময়- পথে আভীর দস্যুরা যাদব-নারীদের লুণ্ঠন করে। কৃষ্ণের মৃত্যু ও নিজ দৈবশক্তি হানির ফলে ইনি দস্যুদের বাধা দিতে পারেন নাই।
পাণ্ডবরা অর্জুনের পৌত্র (অভিমন্যুর পুত্র) পরীক্ষিত্কে রাজা করে মহাপ্রস্থানে গমন করেন। পথে লোহিত সাগরের তীরে অগ্নিদেবের অনুরোধে অর্জুন গাণ্ডীবধনু ও অক্ষয় তূণ দুটি পরিত্যাগ করেন। হিমালয় পার হয়ে মহাস্থানের পথে যেতে যেতে- দ্রৌপদী, সহদেব, নকুলের পতনের পর অর্জুনের মৃত্যু হয়। ভীমের প্রশ্নে উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেন, –অর্জুন একদিনে শত্রু-সৈন্য বিনষ্ট করবার প্রতিজ্ঞা করে তা রক্ষা করতে অসমর্থ হয়েছিলেন এবং অন্যান্য ধনুর্ধরদের অবজ্ঞা করতেন বলেই এঁর পতন হয়েছে।
পন্ঞ্চ পান্ডবের জন্মকাহিনী- মহাভারত
08জু
ভোজ রাজার কন্যা কুন্তি দেবী বিয়ের আগে একবার দুর্বাসা মুনির সেবা করে এক বর লাভ করেন যাতে তিনি যে কোন দেবতাকে আহ্বান করতে পারতেন এবং সন্তান লাভ করতে পারতেন।
এইভাবে পাওয়া সন্তান সেই দেবতার সব গুনাবলি লাভ করবেন। প্রথমবার ভুলে স্বয়ং সুর্যদেব চলে আসেন। সেই সুবাদে জন্ম নেন মহাবীর শ্রী কর্ণ।
যেহেতু তখন কুন্তি দেবী কুমারী ছিলেন, তিনি লোকলজ্জার ভয়ে ঐ সন্তানকে স্বীকার করতে চাননি। তবে সুর্যদেব তাকে অভয় দিয়ে বলেন এতে তার কুমারিত্ব থাকবে আর তার ঐ পুত্র ভুবনবিখ্যাত বীর হবেন।
তবু লোকলজ্জার ভয়ে কুন্তি দেবী ঐ পুত্রকে গংগাতে ভাসিয়ে দেন। পরে ঐ পুত্র অধিরথ নামে এক সারথীর বাড়ীতে বড় হন এবং দানবীর কর্ণ হিনেবে ইতিহাস বিখ্যাত হন।
কিছুকাল পর কুন্তি দেবীর বিয়ে হল হস্তিনার মহারাজা পান্ডুর সাথে।
কিছুকাল পরে মহারাজা পান্ডু মদ্ররাজার কন্যা মাদ্রী দেবীকে বিয়ে করেন।
মহারাজ পান্ডু একবার শিকারে গিয়ে ভুল বশত হরিন মারতে গিয়ে মিলনরত এক সাধুকে মেরে ফেলেন। মৃত্যুর আগে সাধু তাকে অভিশাপ দেন মহারাজা জীবনে আর কোনদিন স্ত্রীর সাথে মিলিত হতে পারবেননা।
মনের দু:খে মহারাজা বনে চলে যান। তখন তার স্ত্রী কুন্তি দেবী রাজাকে তার দুর্বাসা মুনি থেকে পাওয়া দেবতাদের আহ্বান করে সন্তান পাবার ক্ষমতার কথা বললেন। তারপর তারা দুজনে মিলে ঠিক করলেন দেবতাদের থেকে তারা সন্তান নিবেন। তারা প্রথমে একটি ধার্মিক সত পুত্র চাইলেন এবং সেই মোতাবেক ধর্ম দেবতাকে আহ্বান করলেন। ধর্মদেবতার মাধ্যমে জন্ম নিলেন যুধিণ্ঠির, যাকে জগতজোড়া মানুষ ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির হিসাবে জানে।
এখন ধার্মিক ছেলে তো হল, এবার দরকার একজন মহা শক্তিশালী পুত্র। দেবতাদের মধ্যে সবচাইতে শক্তিশালী হলেন পবন দেব বা বায়ু দেব। কুন্তির আহ্বানে আসলেন পবন দেব, জস্ম নিলেন ভীম, মহাপরাক্রমশালী ভীম। তিনি গদাযুদ্ধে বিখ্যাত ছিলেন।
মহারাজা পান্ডু আর কুন্তি দেবী এবার ভাবলেন তাদের ধার্মিক পুত্র হল শক্তিশালী পুত্র হল এবার দরকার সর্বগুনে গুনান্বিত একটি পুত্র।
দেবতাদের মধ্যে সর্বগুনের অধিকারী হলেন দেবরাজ ইন্দ্র। সুতরাং ইন্দ্রকে আহ্বান করা হল, আর জস্ম নিলেন ত্রিভূবনখ্যাত মহাবীর অর্জুন যাকে পার্থ, গান্ডিবি, সব্যসাচী ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়।
এদিকে তাদের তিন পুত্র সন্তান হওয়াতে মহারাজার অপর রানী মাদ্রী দেবী বললেন তারও পুত্র সন্তান চাই, আর তাকেও বর ব্যাবহার করতে দিতে হবে। তখন কুন্তি দেবী মাদ্রী দেবীকে ঐ বরটা একবার মাত্র ব্যাবহার করার অনুমতি দেন।রানী মাদ্রী ভাবলেন একবারে একটিই পুত্র হবে, তবে অশ্বিনী কুমার ভ্রাতৃদ্বয় হলেন একের মধ্যেই দুইজন। অর্থাত তারা আনলে দুটি পুত্র পাবেন। সেই মোতাবেক তাদেরই ডাকা হল আর জস্ম নিলেন দুই পুত্র নকুল আর সহদেব।
এই হল পন্চ পান্ডবের জন্মকাহিনী।
http://www.somewhereinblog.net/blog/HELLOPOP/29679893
মন্তব্য দিন
Posted by gunikanon চালু করুন জুলাই 8, 2013 in হিন্দু ধর্ম
রাবনের সীতা অপহরণ- রামায়ন
ত্রেতা যুগে অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র, রামায়নের অন্যতম প্রধান চরিত্র রাম বাবার ইচ্ছায় ১২ বছরের জন্য বনবাসে যান।সাথে ছিলেন পত্নী সীতা আর ভাই লক্ষন। বছর দশেক এদিক সেদিক ঘুরে এক বনে আসলেন, বনের নাম পন্চবটি। বনটি সীতার খুব পছন্দ হওয়াতে তারা আপাতত সেখানেই থাকতে সিদ্ধান্ত নিল।
ভালই দিন কাটছলি তাদের। হঠাৎ ঘুরতে ঘুরতে সেখানে এলেন লংকা অধিপতি মহাবীর রাবনের বোন শুর্পনখা। জংগলের মধ্যে সুদর্শন রামকে দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমেই পড়ে গেলেন আর তাকে বিয়ে করতে বললেন।
রাম তাকে বুঝিয়ে বললেন যে তিনি বিবাহিত আর তার দ্বিতীয় বিয়ে করার কোন ইচ্ছাই নেই্। কিন্তু শুর্পনখা তাতে প্রবোধ মানলেননা। তখন রাম পাশে ভাই লক্ষনকে দেখিয়ে বললেন ‘তাহলে তুমি তাকে বিয়ে কর’। কিন্তু লক্ষনও রাজি হলেননা। এতে শুর্পনখা রেগে মেগে সীতাকেই আক্রমন করলেন। তখন লক্ষন তার নাক কেটে তাকে লংকায় পাঠিয়ে দিলেন।
শুর্পনখা তখন তার ভাই ‘খর’ আর ১২০০০ সৈন্য পাঠাল রামকে শায়েস্তা করার জন্য। কিন্তু দুই ভাই রাম আর লক্ষনের হাতে তারা সবাই নিহত হল।
অবশেষে শুর্পনখা তার ভাই লংকার রাজা বিশ্রবা মুনির পুত্র রাবনের কাছে গিয়ে বলল সীতার অসাধারণ রুপের কথা আর বলল তাকে বিয়ে করার কথা।
পাঠক /পাঠিকা, এই শুর্পনখাই কিন্তু রামায়নের মূল হোতা, সে না থাকলে রামায়নই হতনা বলে অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন।
যাহোক রাবন অসাধারণ বুদ্ধিমান আর অনেক বড় বীর ছিলেন। তিনি অবশ্য রাম লক্ষনের বীরত্ব সম্পর্কে ভালই জানতেন। তাই রণ কৌশল হিসেবে তিনি তার ভাই মারীচকে বললেন মায়া হরিণের ছদ্মবেশে গিয়ে রাম লক্ষনকে ভুলিয়ে দুরে নিয়ে যেতে, যাতে সীতাকে হরণ করা যায়।
মারীচ পন্ডিত ছিলেন। তিনি রাবনকে সদুপেশই দিলেন আর বললেন এসব না করার জন্য, তাতে ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু কে শোনে কার কথা, রাবন মারীচকে হরিনের বেশে পাঠিয়ে নিজে গেলেন ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে রামের এলাকায়।
এদিকে মায়া হরিন বেশে মারীচকে দেখে সীতা বলল তার ঐ হরিন চাই। রাম গেলেন ঐ হরিন ধরতে আর ভাই লক্ষনকে রেখে গেলেন সীতার পাহারায়।
রাম হরিনকে তীর ছুড়লেন, হরিন বেশে মারীচ মারা যাবার আগে ‘হা লক্ষন’ বলে চিৎকার করল। ওদিকে সীতা এই শব্দ পেয়ে লক্ষনকে বলল রামের সাহায্যে যাবার জন্য। লক্ষন সীতাকে অরক্ষিত রেখে যেতে রাজি হলনা তবে সীতার বারবার অনুরোধের পর তার কুটিরের বাইরে একটা রেখা টেনে বলল এই ‘লক্ষনরেখা’র বাইরে না যেতে।
এই সুযোগে রাবন এসে সীতার ভিক্ষা চাইবার ছল করে সীতার কুটিরে আসে। সীতা লক্ষনরেখার বাইরে না আসতে চাইলে ভিক্ষুকরুপী রাবন রেগে যায়, তখন সীতা বাধ্য হয়ে লক্ষনরেখা পার হয়ে বাইরে এলেই রাবন তাকে নিয়ে লংকায় রওয়ানা দেয়।
পথিমধ্যে রামের বাবা দশরথের বন্ধু গরুরের পুত্র জটায়ু নামক বিশাল পাখি রাবনের সীতা হরণের চেস্টা দেখে বাধা দেয়। তবে যুদ্ধে হেরে গিয়ে সে আহত হয়। রাবন সীতাকে নিয়ে লংকায় চলে যান।
এভাবেই রাবন সীতাকে হরণ করেন আর এক মহা সংগ্রামের সুত্রপাত হয়, সৃস্টি হয় রামায়নের।
অ্যাস্ট্রলজি ও ধর্ম
08জু
পৃথিবীর ইতিহাসের বিতর্কিত বিষয়গুলির একটি হল অ্যাস্ট্রলজি। বিশ্বের বলতে গেলে অর্ধেক মানুষ অ্যাস্ট্রলজিতে বিশ্বাস করে, বাকী অর্ধেক করে না। তবে এইসকল অবিশ্বাস, বিতর্কের মধ্যেও অ্যাস্ট্রলজি যুগ যুগান্তর ধরে বীরদর্পে মানুষের মধ্যে টিকে আছে। আমি এখন নানা ধর্মে অ্যাস্ট্রলজির অস্তিত্ব প্রমান করার চেষ্টা করব। পৃথিবীর বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বড় ধর্ম খ্রিস্টান। প্রথমে তাই খ্রিস্টান ধর্মে আসি। বাইবেল হতে জানা যায়, মাতা মেরীর কোলে যীশুর জন্ম হয়েছিল, সেই দিন রাতে পৃথিবীর তিন প্রান্ত থেকে তিন জ্ঞানী ব্যক্তি যীশুকে এক ঝলক দেখার জন্য ছুটে আসে।বাইবেল বিশ্লেষণে জানা যায়, এই তিন জ্ঞানী ব্যক্তি আকাশের গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে যীশুর জন্মগ্রহণ সম্পর্কে অবহিত হন। আর আকাশের গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে কোন জাগতিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার বিদ্যাই হল অ্যাস্ট্রলজি। তাই দেখা যাচ্ছে খ্রিস্টান ধর্ম অ্যাস্ট্রলজির অস্তিত্ব স্বীকার করছে। এবার বৌদ্ধ ধর্মে আসি। গৌতম বুদ্ধের পিতা ছিলেন রাজা। বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের কাছ থেকে জানা যায়, গৌতম বুদ্ধের জন্মের পর তার পিতা রাজ্যের প্রধান জ্যোতিষীকে নবজাতক বুদ্ধের ভাগ্য গণণার জন্য তলব করেন। জ্যোতিষ গননা করে বলেন এই ছেলের রাজ্য পরিচালনার প্রতি কোন ঝোঁক থাকবে না, যৌবনে এই ছেলে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে সন্ন্যাসী হবে। এবং প্রকৃতপক্ষেই এই ভবিষ্যতবানী সত্য হয়েছিল, বুদ্ধ রাজপ্রাসাদ ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। অর্থাৎ বৌদ্ধধর্মও অ্যাস্ট্রলজির অস্তিত্ব স্বীকার করছে। এবার হিন্দু ধর্ম। হিন্দু ধর্ম আর অ্যাস্ট্রলজি একই সূতায় গাঁথা, অ্যাস্ট্রলজির প্রাচীন উৎপত্তি ভারতীয় আর্যদের মধ্যেই। অ্যাস্ট্রলজি হিন্দু ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, আর তাই পূর্বে হিন্দু পুরোহিতদের অবশ্যই বাধ্যতামূলকভাবে অ্যাস্ট্রলজি শিখতে হত। সবশেষে ইসলাম ধর্মে আসি। আমরা যারা মুসলিম তারা প্রায় সবাই মোটামুটিভাবে হযরত মুসা (আ) ও ফেরাউনের কাহিনী জানি। মুসা নবীর জন্ম হয় বনী-ইসরাইল পরিবারে। মুসার জন্মের পরপর মিশরের ফেরাউন এক স্বপ্নে দেখেন, বনী-ইসরাইল বংশ থেকে একটি আগুনের গোলা এসে ফেরাউনের সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই স্বপ্ন দেখে ফেরাউন চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং রাজ্যের সকল জ্যোতিষীদের খবর দেন। জ্যোতিষীরা গননা করে ফেরাউনকে বলেন, বনী-ইসরাইল বংশে এমন এক মানব সন্তানের জন্ম হবে যে ফেরাউনের ধ্বংসের কারন হবে। এই ভবিষ্যতবানী সত্য হয়েছিল। বনী-ইসরাইল বংশে জন্ম নেয়া হযরত মুসা (আ) ই ফেরাউনের ধ্বসের কারণ হয়েছিল। এভাবে ইসলাম ধর্মেও অ্যাস্ট্রোলজির অস্তিস্ব স্বীকার করা হয়েছে।
প্রাচীন গ্রিসের ওপর পারস্যের প্রভাব
07জু
গ্রিস। অনন্য সভ্যতা হলেও শূন্য থেকে সৃস্টি হয়নি ..
পারস্য। গ্রিসকে করে রেখেছে ঋণী
গ্রিস ও পারস্যের রেষারেষির কথা আমরা জানি। সে দ্বন্দে গ্রিসকেই বড় করে দেখানো হয়েছে। অথচ, পারস্য নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল গ্রিসকে। এমন কী পারসিক শিল্পের প্রভাব আথেন্সের পার্থেনন ও এরিকথিয়ামের কারিয়াতিদসগুলোর ওপরও পড়েছিল। অবশ্য অন্যভাবে, অর্থাৎ, বিমূর্তভাবে। অ্যাক্রোপলিসের শিল্প কেবলমাত্র দৃশ্যমান রুপ নয়, বরং একটি আদর্শিক ধারণাও ছিল, যা পারস্যের শিল্পরীতি অনুকরণ। “সম্রাটের অধীনে ঐক্যের” ধারণাটি ছিল পারসিক: এবং সেটি গ্রহন করেছিল গ্রিস । গ্রিক শিল্পীরা ওই আনুগত্যের ধারণাটি পার্থেননের দেওয়ালচিত্রে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছিল। অবশ্য যথার্থ চিত্রকল্পের মাধ্যমে গ্রিক রুচি অনুযায়ী প্রকাশ পেয়েছিল এবং শিল্পকর্ম হিসেবেও সেটি সার্থক হয়েছিল । কারিয়াতিদসগুলোর আদিরুপ ছিল ষাঁড় কিংবা ডানাঅলা বেড়াল। তবে সেসসব উপেক্ষা করে গ্রিক মনোবৃত্তটি নারীর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল। গ্রিকরা স্পস্টতই পশুর তুলনায় নারীকেই আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে যথার্থ মনে করেছিল।
এই বিষয়গুলো প্রমাণ করে যে গ্রিসের শিল্পরীতিতে পারস্যের প্রভাব ছিল অনিবার্য। রাজনীতির ক্ষেত্রেও ওই একই কথা বলা যায়। গ্রিক ও পারসিকরা দীর্ঘকাল আইওনীয় নগররাষ্ট্রগুলি শাসন করেছিল। সাম্রাজ্য পরিচালনার অভিজ্ঞতা যেহেতু গ্রিকদের ছিল না, পারসিকদের ছিল, গ্রিকরা পারসিকদের পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করতে বাধ্য ছিল। গ্রিকরা পারসিকদের পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করে কর প্রদানের নীতিমালা প্রনয়ন করেছিল, একটি সুসংগঠিত নৌবাহিনী গড়ে তুলেছিল এবং করদ রাজ্যগুলি তত্ত্বাবধানের জন্য পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছিল।
অ্যাক্রোপলিসের নির্মানসৌকর্যেও পড়েছিল পারসিক স্থাপত্যরীতির প্রভাব …
আসলে তো এমনই হওয়ার কথা ছিল। কারণ, অন্যদের দ্বারা বিকশিত জ্ঞান প্রয়োগ করেই তো মানবসভ্যতা এগিয়ে চলেছে । অথচ, উনিশ শতকের ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগন গ্রিক সংস্কৃতিতে পারস্যের অবদান সচেতনভাবে উপেক্ষা করেছেন। তারা অলীক এক ‘গ্রিক দৈবে’ (Greek miracle) দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, যা রীতিমতো হাস্যকর। প্রাচ্যের অর্ন্তনিহিত শক্তিকে বোঝার মতন প্রতিভা উনিশ শতকের- এমন কী বিংশ শতকের অধিকাংশ ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগন দেখাতে পারেননি। আসলে ইউরোপীয় ইতিহাস চর্চার ঝোঁকটা বরাবরই ছিল এমনই; পক্ষপাতদুষ্ট। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক সংস্পর্শকে বরাবরই অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। কিন্তু, আজ আমরা জানি, দুটি সাংস্কৃতির অনিবার্য প্রভাবকে অগ্রাহ্য করা যায় না। এমন কী দ্বন্দকেও।
এই বিষটি নিয়েই নেদারল্যান্ডের বিখ্যাত গবেষক Janine Bakker: লিখেছেন Persian influence on Greece নামে একটি অসাধারন নিবন্ধ।
Janine Bakker. ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছেন লন্ডনে। হল্যান্ডবাসী। সেখানেই থাকেন। একটি স্কুলে পড়ান। অসাধারন নারী। প্রাচীন গ্রিসের ওপর প্রাচীন পারস্যের প্রভাবের সরুপটি করেছেন উন্মোচন।
গ্রিক উপকথার সেই ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধারা
05জু
এ্যামাজন নারীযোদ্ধা। সুদূর অতীতের কোথাও কি গড়ে উঠেছিল একটি নারীরাজ্য? যে নারীরাজ্যটিতে কেবল বাস করত নারীরা-যে নারীরাজ্যটি তে পুরুষের কোনওই অস্তিত্ব ছিল না। কী এর কারণ? যা আজও বিস্ময় ও কৌতূহলের সৃষ্টি করে চলেছে এবং অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। কেন তারা গড়ে তুলেছিল পুরুষবিহীন রাষ্ট্র? সুন্দরী রক্তপিপাসু নারী যোদ্ধাদের কথা ইউরোপীয় উপকথায় রয়েছে। কেমন ছিল এ্যামাজন যোদ্ধা নারীরা ? ইউরোপীয় মননে এ্যামাজন নারীদের প্রভাব এতই গভীর যে স্পেনিশ অভিযাত্রী ফ্রানসিসকো দে ওরেলানা দক্ষিণ আমেরিকার সবচে বড় নদীটির নাম দিয়েছেন এ্যামাজন । কেন? কারণ সেই নদীর পাড়ে যুদ্ধংদেহী নারী যোদ্ধাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন…
‘এ্যামাজন’ নারীরা যোদ্ধাদের কথা গ্রিক উপকথায় উল্লেখ আছে। গ্রিক উপকথামতে যুদ্ধের দেবতা আরেস ও সমুদ্রশঙ্খিনী (সি নিম্ফ) হারমোনিয়া থেকে ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধারা উদ্ভূত । তারা উপাসনা করত দেবী আর্তেমিসের।
কেবল উপকথা নয়, ঐতিহাসিক হিরোডোটাসও ‘এ্যামাজন’ নারীদের কথা উল্লেখ করেছেন। হিরোডোটাস এর মতে ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধারা পুরুষ খুনি! তারা বিরতিহীন ভাবে যুদ্ধ করেই যেত গ্রিক এবং অন্য জাতির বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধকে গ্রিক ভাষায় বলা হয় Amazonomachy বা এ্যামাজন যুদ্ধ। ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধারা এমন কী ট্রয়যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তারা ট্রয়ের পক্ষেই ছিল। ‘এ্যামাজন’ রানী কে হত্যা করেছিলেন গ্রিকবীর অ্যাকিলিস।
কিন্তু কোথায় ছিল ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধাদের রাজ্য?
এশিয়া মাইনরে অবস্থিত কৃষ্ণসাগর। গ্রিকরা মনে করত ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধাদের রাজ্যটি ছিল এই কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে।
এবার Amazon শব্দটির উদ্ভব বিষয়ে আলোচনা করা যাক।
এ্যামাজন নারীরা ছিল মূলত যোদ্ধা। সে কালে তীরধনুক ছিল অন্যতম যুদ্ধাস্ত্র। এ্যামাজন সমাজে মেয়েদের বালিকা বয়েস থেকেই হতে হত দক্ষ তীরন্দাজ । ধনুক বাঁকাতে বুকে ডান দিকে চাপ পড়ে; যে কারণে বালিকার ডান স্তনটি নাকি তার মা পুড়িয়ে ফেলত। গ্রিক ভাষায় স্তনশূন্যতাকে বলে: এ্যামাজন। a মানে, ছাড়া; আর mazos মানে স্তন। এটি অবশ্য লোকভাষ্য। এর কোনও ভিত্তি নেই। কেননা, বর্তমান কালে নারী তীরন্দাজের শরীর অন্তরায় নয়। তা ছাড়া এ্যামাজন বালিকাদের স্তন পোড়ানোর বিষয়টিকে বিশেষজ্ঞ অবশ্য অস্বীকার করেন। তারা বলেন যে এতে যে ক্ষতের সৃষ্টি হত সেটির চিকিৎসাকৌশল সেকালে আয়ত্ম সম্ভব ছিল না!
গ্রিক ভাষ্যমতে এ্যামাজন নারীদের সমাজ পুরুষশূন্য মাতৃতান্ত্রিক সমাজ । পরিশ্রমের কাজ করত দাসীরা। বছরে একবার প্রতিবেশী রাজ্যে যেত। উদ্দেশ্য যৌন মিলন। পুত্রসন্তান জন্মালে মেরে ফেলত কিংবা বাবার কাছে রেখে আসত। প্রথম তারাই ঘোড়াকে বশ মানিয়েছিল। তীরধনুক ছাড়াও যুদ্ধে ব্যবহার করত বর্শা ও কুঠার।
গ্রিক ভাষ্যমতে এ্যামাজন নারীদের সমাজ শাসিত হত একজন রানীর মাধ্যমে। রানী হিপ্পোলিটা ছিলেন একজন বিখ্যাত নারীশাসক। আমি বারবার গ্রিক ভাষ্যমতে বলছি । কেননা, উল্লিখিত তথ্যগুলির উৎস গ্রিক উপকথা ও ঐতিহাসিক হিরোডোটাস। পরে আমরা এ্যামাজন নারীদের বিষয়ে আধুনিককালের ঐতিহাসিকদের বক্তব্য উল্লেখ করব। যা হোক। এ্যামাজন রানী হিপ্পোলিটার বাবা ছিলেন যুদ্ধের দেবতা আরেস। আরেস কন্যাকে একটি যাদুময় কোমারবন্ধনী (গার্ডেল) উপহার দিয়েছিলেন। যা হোক। আমরা উপকথায় প্রবেশ করি। …থেসিয়াস ছিলেন পুরাকালের এথেন্স নগরীর একজন রাজা। তিনি গ্রিক উপকথার স্বর্গীয় বীর হেরাক্লেস কে এ্যামাজনদের বিরুদ্ধে সমরাভিযানে প্রেরণ করেছিলেন। সেই অভিযানে রাজা থেসিয়াস নিজেও অংশ গ্রহন ছিলেন। আসলে সেই অভিযানের পিছনে ছিল রানী হিপ্পোলিটার যাদুময় কোমারবন্ধনীর লোভ। যা হোক। এশিয়া মাইনরের কূলে রাজা থেসিয়াস এর জাহাজ ভিড়ল । ধরা যাক আজকের তুরস্কের উপকূলে। রাজা থেসিয়াস প্রথমেই আক্রমনাত্মক ভূমিকা অবলম্বন করলেন না । রানী হিপ্পোলিটা সন্তুষ্ট হয়ে হাজারো উপঢৌকন নিয়ে স্বয়ং গ্রিক জাহাজে এলেন। রানী হিপ্পোলিটা সম্ভত রূপবতী ছিলেন। কিংবা রাজা থেসিয়াস ছিলেন পুরুষ! জাহাজে উঠতেই জোর করে রানী হিপ্পোলিটা কে বিয়ে করে বসলেন রাজা থেসিয়াস । যাক বিয়ে করলেন! না করলেও পারতেন। জাহাজ ভেসে চলেছে পশ্চিমমূখি। জাহাজ যখন এথেন্স বন্দরে ভিড়ল ততদিনে রানী হিপ্পোলিটা গর্ভবতী। ওদিকে রাজা থেসিয়াস-এর এই জঘন্য অপকর্ম আরও একটি Amazonomachy-এর জন্ম দিল।
রানী হিপ্পোলিটা যথা সময়ে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। সেই পুত্র সন্তানের নাম রাখা হল হিপপোলিটাস। রাজার মোহভঙ্গ হল। রাজা হিপ্পোলিটা কে বললেন, ‘এবার তুমি নরকে যাও।’ হিপ্পোলিটা মনে আঘাত পেলেন। ফিরে গেলেন এশিয়া মাইনরে এ্যামাজনদের রাজ্যে ।
এখানেই শেষ নয়।
রাজা থেসিয়াস বিয়ে করলেন ফেড্রাকে। কে ফেড্রা ? ফেড্রা ছিলেন ক্রিট দ্বীপের রাজা মিনোস এর কন্যা। এই মিনোসের নামেই ক্রিট দ্বীপের সভ্যতাকে বলা হয় মিনিয় সভ্যতা। যাক হোক। ঘটনা মোড় নিল অন্যদিকে। হিপপোলিটাস তখন কিশোর। কিশোর হিপপোলিটাস এর প্রেমে পড়লেন ফেড্রা । (উপকথা কেন এত লোকপ্রিয় তা নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে!) হিপপোলিটাস -ফেড্রার ভালোবাসা নিয়ে গ্রিক নাট্যকার ইউরিপিদেস নাটক লিখেছেন । দু-বার সে নাটক মঞ্চস্থ করেছেন এথেন্সের নাট্যশালায়। এমন কী শেকসপীয়ারের ‘আ মিডসামার নাইটস ড্রিম’ নাটকে আমরা রাজা থেসিয়াস আর রানী হিপ্পোলিটা দেখতে পাই।
গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস যাদের ‘পুরুষ খুনি’ বলেছেন, তারা আসলে কারা? গ্রিক উপকথার সেই ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধারা আসলে কারা? তারা কি সম্পূর্নতই উপকথারজাত? না, তাদের বাস্তবিক কোনও অস্তিত্ব ছিল?
বর্তমানকালের ঐতিহাসিকগন এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেস্টা করেছেন। এশিয়া মাইনরে অবস্থিত কৃষ্ণসাগরের আশেপাশে গড়ে উঠেছিল সাইদিয় সভ্যতা। ৮০০ খ্রিস্টপূর্বে এদের অবস্থান সম্পর্কে গ্রিকরা সচেতন হয়। Scythians দের বাংলায় বলা হয় শক।
গ্রিক উপকথার সেই ‘এ্যামাজন’ নারী যোদ্ধারা আসলে শক নারী!
শক সভ্যতায় যে সক্রিয় নারীযোদ্ধা ছিল, তার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমান মিলেছে। শকদের সভ্যতার কেন্দ্র ছিল বর্তমানকালের ক্রিমিয়া। শক সমাধিক্ষেত্রে খনন কার্য চালিয়ে সশস্ত্র নারীর অস্তিত্ব মিলেছে। দেখেশুনে মনে হয় শকদের সৈন্যবাহিনীতে অন্তত ২৫% নারী যোদ্ধা ছিল। আর সেসব শক নারী যোদ্ধাদের ধনুকসহ সমাধিস্থ করা হত।
ক্রিমিয়ার অন্ঞ্চল; ৮০০ খ্রিস্টপূর্বে এখানেই উদ্ভব হয়েছিল সাইদিয় বা শক সভ্যতার। যাদের নারীযোদ্ধা ছিল। এদেরই গ্রিকরা নানা ভাবে বনর্না করেছে। যাদের কথা ইউরিপিদেস থেকে শেকসপীয়ার অবধি রচনায় উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু কেন শকরা নারীরা যুদ্ধবিদ্যাকে অত সিরিয়াসলি গ্রহন করেছিল?
রুশ প্রত্নতাত্ত্বিক ভেরা কোভালেভস্কায়া এর উত্তর দিয়েছেন। কোভালেভস্কায়া মনে করেন শক পুরুষরা যুদ্ধ কিংবা শিকারের জন্য দূরবর্তী স্থানে দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করত। যে কারণে যাযাবর শক নারীরা তাদের পশু ও চারণভূমি প্রতিরক্ষার্থে হাতে যুদ্ধাস্ত্র তুলে নেয়। সে সময়টায়, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ শতকের দিকে শকরা এশিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ভেরা কোভালেভস্কায়া গবেষনা করে দেখেছেন এই প্রক্রিয়ায় একাধারে ২৮ বছর অবধি শক নারীদের একা পুরুষবিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হত!
পুরুষশূন্য সেই সব শক নারীদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিরি সব কল্পকাহিনী ছড়িয়েছে গ্রিস। (এখনও বাংলাদেশি সমাজে নারী একা থাকলে কত কথা ওঠে!) শকদের পুরুষবিহীন সমাজটি গ্রিকদের নারীরাজ্য মনে হতেই পারে। আর নারীদের নিয়ে মুখরোচক আলোচনার তো শেষ নেই। ‘এ্যামাজন’ বালিকাদের তীরধনুক ছোঁড়া শিখতে হত। ধনুক বাঁকাতে বুকে ডান দিকে চাপ পড়ে; যে কারণে বালিকার ডান স্তনটি তার মা পুড়িয়ে ফেলত। গ্রিক ভাষায় স্তনশূন্যতাকে বলে: এ্যামাজন। ইত্যাদি …ইত্যাদি …
পরিবারের প্রধান পুরুষ জীবিকার তাগিদে দীর্ঘকাল অনুপস্থিত থাকলে সেই পরিবারের বিপদশঙ্কুল পরিবেশে আত্মরক্ষার অধিকার তো আছে …কি বলেন …
গ্রীক পুরাণের দেব-দেবীদের মানব সভ্যতায় প্রভাব। শেষ পর্ব
04জু
ধারাবাহিকটির শেষ পর্ব শুরু করছি পৃথিবীর নাভিমূল থেকে। দেবতা জিউস দুটি ঈগল পাখি পাঠায় পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু বা নাভিতে মিলিত হতে, ঈগল দু’টি ডেলফিতে অবতরণ করে। সে মিলিত স্থানকে চিহ্নিত করা হয় অম্ফালস পাথর দিয়ে। পাথরটির মাঝখানে ফাঁপা। আবার মিথ মতে এই অম্ফালস পাথর দানব সর্দার ক্রোনাস দেবতা জিউসকে উপহার দেয়। সবচেয়ে বিখ্যাত পাথরটির অবস্থান ডেলফিতে এপোলোর উপাসনালয়ে; এছাড়া জেরুজালেম, থাইল্যান্ড ইত্যাদি জায়গায় ভিন্নতর অম্ফালস আছে।
বলা হয় যে বিশেষ পাথরের মাধ্যমে দেবতার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা যেতো। এটি মহাজাগতিক থাম যা স্বর্গ ও পৃথিবীকে পৃথক করে আর পৃথিবীতে ভূমির জন্ম দেয়। তারপর ভূমিতে জন্ম হয় গাছের প্রাণের। বিভিন্ন ধর্মে পৃথিবীর প্রথম ভূমিকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হয় এবং এরকম কিছু দিয়ে তার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। মিশরীয় সভ্যতায় একে বলা হয় বেনবেন; রোমে টায়ার ও বেথেল; হিন্দু ধর্মে শিবলিঙ্গ। এছাড়া আমাদের ইসলাম ধর্মেও একটি গুরুত্বপূর্ণ পাথর মক্কায় রয়েছে, যার নাম আল-হাজার আল-আসওয়াদ। এটি সম্পর্কে আপনারা ভালো জানেন তাই আলোচনায় যাচ্ছি না অথবা Black Stone।
দেব-দেবীদের উপাসনালয় ও অন্যান্য স্থাপনা পুরো গ্রীক জুড়ে এবং আশেপাশে ছড়িয়ে আছে। অনেকগুলো আবার হারিয়ে গেছে সময়ের সাথে সাথে। ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতির উপাসনালয় আফ্রোদিসিয়াস ছিলো অনেক সুন্দর, অবস্থান তুর্কীস্থানে। সেখানে ছিলো স্ট্যাডিয়াম, থিয়েটার প্রভৃতি।
পাহাড়ের গুহা ও তার গা জুড়ে ছিলো প্যানের উপাসনালয়। পাহাড়ের গায়ে পাথর কেটে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি রাখার স্থান করা হয়েছিলো। গুহা থেকে বের হয়েছিলো বিশাল আকারের ঝর্ণা, আর এই জায়গাটি পৌত্তলিকদের পূজার কেন্দ্রস্থান হয়ে যায়। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের শুরুতে এখানে দেবতা প্যানের জন্য বলী দেয়া হতো। এই শহরটির আগে নাম ছিলো প্যানিয়াস, আরবি ভাষায় পরিবর্তীত নাম বানিয়াস।
খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে লিবিয়ার ছিলো দেবতা জিউসের উপাসনালয়।
নাক্সোস দ্বীপে রয়েছে দেবী ডিমিটারের চমৎকার উপাসনালয়।
ডেলফিতে আছে দেবতা এপোলোর উপাসনালয় ও স্থাপনা।
ডেলফিতে দেবী এথেনারও উপাসনালয় আছে।
পায়েস্তাম, ইতালিতে আছে হেরা, এথেনা, এপোলো, জিউস ও পোসাইডনের উপাসনালয়।
গ্রীক পুরাণের দেব-দেবীদের মানব সভ্যতায় প্রভাব। পর্ব-২
04জু
প্রাচীন গ্রীসের ইতিহাস শুরু হয় পাথর যুগের শিকারি ও শুরুর দিকের কৃষকদের থেকে। বিভিন্ন যুগ পার করে বিভিন্ন ইতিহাসের ভেতর দিয়ে আজকের গ্রীসের চেহারা হয়েছে ভিন্নতর, তবুও ধ্বংসস্তুপে খুঁজে পাওয়া যায় সে প্রাচীন অতীত ঐতিহ্য।
গ্রীক পুরাণ পাশ্চাত্যে চিত্রকলা, সংস্কৃতি, সিনেমা ও সাহিত্যে সবসময় প্রেরণার যোগান দিয়েছে। গ্রীক পুরাণ ও লোককাহিনী এখনো পাশ্চাত্যে বহু নাট্যকার, আঁকিয়ে, লেখক, দার্শনিক, এমনকি বিজ্ঞানীদেরও অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করছে। যেমন – প্রমিথিউসের যকৃতের পুনর্জন্মের বিযয়টি চিকিৎসা বিজ্ঞান উপলব্ধি করতে পেরেছে। অনেক ঔষধ তৈরীকারী প্রতিষ্ঠানও তাদের পণ্যে প্রমিথিউসের নাম ব্যবহার করে থাকে। অনেক আকাশযান, গ্রহ, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উপগ্রহ, গ্রহাণু, ধূমকেতু প্রভৃতির নামও গ্রীক পুরাণের বিভিন্ন চরিত্রের নামে নামকরণ হয়ে আসছে।
প্রারম্ভিক গ্রীসবাসিরা মনে করতো রোগ-শোক দেব-দেবীদের কারণে হয় এবং শুধুমাত্র তারাই এর থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে। পুরোহিতের এ কাজে মানুষ ও দেব-দেবীদের মধ্যে সংযোগ ঘটাতো ও রোগ মুক্তিতে সহায়তা করতো। পরবর্তীতে আগুন, পানি, মাটি ও বায়ুর সমন্বয়ে গঠিত হয় পদার্থ এর উপর ভিত্তি করে গ্রীক চিকিৎসকরা রোগীর আরোগ্যের জন্য একটি তত্ত্ব বের করেন। তারা বিশ্বাস করতো মানব শরীর চারটি তরল বা রস দিয়ে গঠিত। মানুষের দৈহিক ও মানসিক গুণাবলীর নিয়ামক বলে পরিচিত রস চতুষ্টয় হল – হলুদ পিত্তরস, কালো পিত্তরস, কফ ও রক্ত। রোগ ও দূর্বলতা তখনই হয় যখন এই চারটির ভারসাম্য নষ্ট হয়। তো এই বিষয়টি ব্যবহার করে গ্রীক চিকিৎসকরা রোগীর স্বাভাবিক আরোগ্যের জন্য বিপরীতমুখী পদ্ধতি বের করেন। যেমন – রোগীর ঠান্ডার ক্ষেত্রে তারা উষ্ণতা ও শুষ্কতা প্রদান করতো।
সে সময়ের কিছু বিখ্যাত দার্শনিকের নাম আমরা সকলেই জানি – প্লেটো (খ্রীষ্টপূর্ব ৪২৭ – ৩৪৭), এরিস্টটল (খ্রীষ্টপূর্ব ৩৮৪ – ৩২২) ও সক্রেটিস (খ্রীষ্টপূর্ব ৪৬৯ – ৩৯৯)। এরা সকলেই প্রাচীন গ্রীসের ইতিহাসকে আরো সমৃদ্ধ করেছেন। এছাড়া ছিলেন গণিতবিদ পিথাগোরাস ও আর্কেমিডিস, শাসক আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট।
প্রাচীন গ্রীসের আটলান্টিস দ্বীপ নিয়ে আছে অনেক বিতর্ক। বলা হয় যে এথেন্স আক্রমণের এক ব্যর্থ অভিযানে ভুলক্রমে আটলান্টিস একদিনেই সাগরে ডুবে যায়।
গ্রীক ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলো হলো ট্রোজন যুদ্ধ (খ্রীষ্টপূর্ব ১২ বা ১৩ শতাব্দীতে), পার্সিয়ান যুদ্ধ (খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ – ৪৪৯) ও পেলোপোনেসিয়ান যুদ্ধ (খ্রীষ্টপূর্ব ৪৩১ – ৪০৪)।
প্রারম্ভিক গ্রীসের লোকজন ও ট্রয়বাসীর মধ্যে হয় ট্রোজন যুদ্ধ।
পার্সিয়ান রাজ্য ও গ্রীক সিটি-স্ট্যাটস এর ভেতর হয় পার্সিয়ান যুদ্ধ।
আর এথেন্স ও স্পারটার ভেতর হয় পেলোপোনেসিয়ান যুদ্ধ।
যার অবস্থান আটলান্টিক সাগরের মধ্যভাগে। সুপ্রাচীন অলিম্পিক খেলা সে সময় ধর্মীয় ও ক্রিয়ামূলক অন্যতম উৎসব ছিলো, যা প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হতো গ্রীসের অলিম্পিয়ায় জিউস দেবতার পবিত্র স্থানে। যেখানে গ্রীক প্রজাতন্ত্রের সকল রাজ্য ও ছোট-বড় শহর অংশ গ্রহণ করতো। তখনকার অলিম্পিক খেলার অন্যতম অংশ ছিলো যুদ্ধ ও রথ দৌড়। লোককাহিনী অনুসারে জিউস পুত্র হেরাক্লিস বা হারকিউলিস অলিম্পিক খেলার ডাক দেয়।
সে জিউসের সম্মানে অলিম্পিক স্টেডিয়াম তৈরী করে। অধিকাংশের মতে প্রাচীন অলিম্পিক খেলা শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৭৭৬ সালে, যা হাজার হাজার বছর ধরে খেলা হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতেও প্রতি চার বছর পর পর অলিম্পিক খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
গ্রীসের সবচেয়ে উঁচু পর্বত হলো মাউন্ট অলিম্পাস, যা গ্রীক পুরাণে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেব-দেবীদের বাস অলিম্পাস পর্বতে। দেবতাদের রাজা জিউসের অবস্থান ঐ পর্বতের শীর্ষস্থানে। জিউস সহ মোট বারো জন নিয়ে গঠিত সেখানকার বাসকারী অলিম্পিয়ানস। এই বারো জনের ভেতর আছে তার স্ত্রী হেরা, পুত্র এপোলো, আফ্রোদিতি, পোসেইডন, হার্মেস, এথেনা, এরেস, হেডেজ ও ডিমিটার।
লোককাহিনী মতে এথেন্স নগরীর নামকরণ হয়েছে জিউস কন্যা বিজ্ঞতার দেবী এথেনার নাম অনুসারে। সে শহরে জিউসের প্রথম স্ত্রী মেটিস গর্ভবতী হলো, এ কথা শুনার পর জিউস তাকে খেয়ে ফেলেছিলো। কারণ সে কারো কাছে জানতে পারে যে জন্মনেয়া শিশুটি জিউসের চেয়েও ক্ষমতা সম্পন্ন হবে। তো জিউস তার স্ত্রীকে গিলে ফেলার কিছুক্ষণ পর তার তীব্র মাথা ব্যথা শুরু হলো, মনে হলো সে যা গিলেছে তা অনেক বড় কিছু। একটু পর তার মাথা চিরে গেলো আর সেখান থেকে আবির্ভূত হলো পরিপূর্ণ দেবী এথেনা। এছাড়া আরেকটি গল্প প্রচলিত আছে। একদিন সাগর দেবতা পোসেইডোনের সাথে দেবী এথেনার ঝগড়া লাগলো নগরীর পৃষ্ঠপোষক কে হবে এটা নিয়ে। এরপর সিদ্ধান্ত হলো – ঐ নগরীকে যে সবচেয়ে ভালো উপহার দিতে পারবে, নগরীর নামকরণ তার নামেই হবে। তারপর পোসেইডোন নগরীর কাছে একটি লবন পানির ঝরণা উপহার দিলো, আর এথেনা উপহার দিলো জলপাই গাছ। তারপর তারা বিবেচনা করে দেখলো যে এথেনার উপহারটিই ভালো। কারণ জলপাইয়ের তেল বাতি জ্বালাতে, রান্না করতে ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যবহৃত হবে। তারপর এথেনার নাম অনুসারে সে নগরের নাম হয়ে গেলো এথেন্স।
প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে বসবাসকারী প্রাচীন গ্রীসের লোকজন তাদের দেব-দেবীদের পূজা করতো, গড়ে তোলেছিলো অনেক উপাসনালয়। সে সময় তাদের জীবন ব্যবস্থা ছিলো অন্যরকম, যা মিথ অপেক্ষা কোন অংশে কম নয়। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া সে সময় ধ্বংসাবশেষের ভেতর দিয়ে দেখতেই আজকের এই প্রয়াস।
খ্রীষ্টপূর্ব ৪৮০-৩২৩ এর ক্লাসিক্যাল যুগ হচ্ছে প্রাচীন গ্রীসের সবচেয়ে বিখ্যাত সময়। এ সময়ই গ্রীকরা উন্নতীর চরম শিখরে পৌঁছায়, আর সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও অনেক এগিয়ে যায়। এ সময় কোন রাজা দিয়ে শাসিত হয়নি, কারণ দেব-দেবীদের প্রভাব ছিলো সবচেয়ে বেশী। খ্রীষ্টপূর্ব ১৪৬ সালে গ্রীসের শহরাঞ্চল রোমানরা দখল করে নেয়। পরবর্তীতে খ্রীষ্ট উত্তর ৪র্থ শতাব্দীতে রোম ভাগ হয়ে গেলে প্রাচীন গ্রীসের পূর্বাঞ্চলের অর্ধেক ভাগ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের হাতে চলে যায়। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৪৫৩ সালে তা অটোমেন সাম্রাজ্যের দখলে আসে। রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি হারানোর পরেই প্রাচীন গ্রীসে জন্ম নিতে শুরু করে অনেক দার্শনিক, লেখক, শিল্পী, চিন্তাবিদ প্রভৃতি। প্রাচীন গ্রীস হয়ে উঠে পশ্চিমাদের সভ্যতার সূতিকাগার।
হাজারো পুরাণ, গল্প ও লোককাহিনী নির্ভর ছিলো প্রাচীন গ্রীসের ধর্ম। গড়ে উঠে পুরাণের বিভিন্ন দেব-দেবীদের উপাসনালয়। কারণ তারা মনে করতো দেব-দেবীরা মানুষের মতো অনুভূতিপ্রবণ, সম্মান দিলে কৃপা পাওয়া যায় নয়তো তারা রুষ্ট হন। দেব-দেবীদের জন্য পশু, খাদ্য ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করতো প্রাচীন গ্রীকবাসী।
গ্রীসের লোকজন সে সময় বিশ্বাস করতো মাটির নিচে মৃতের জন্য আলাদা জগৎ আছে, যেখানে একজন মৃত্যুর খেয়াদেবতা চারোন তাদের ঐ জগতে পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে নিয়ে যায়। প্রাচীন গ্রীক পুরাণ ও ধর্ম অনুসারে সে জগতে ভাল ও মন্দ কর্মকৃতদের জন্য ছিলো আলাদা ব্যবস্থা। সে পাতাল জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতো দেবতা হেডেজ, আর তার রানী পার্সেফোন এ কাজে সাহায্য করতো তাকে। পাতাল একটি রাজ্যের মতো, যা বিভক্ত ছিলো কয়েকটি অঞ্চলে। যারা খারাপ কাজ করতো তাদের শাস্তি ও অত্যাচারের জন্য ছিলো একটি অঞ্চল। ইলিজিয়ান ফিল্ড বা স্বর্গ উদ্যান নামে একটি অঞ্চল ছিলো যারা ভালো কাজ করেছে তাদের জন্য। এই অঞ্চল দ্বয়ের ভাগ মূলত অন্য ধর্মের স্বর্গ-নরকের মতো, তফাৎ শুধু তাদের অবস্থানে – আকাশ ও পাতালে।
প্রাচীন গ্রীসের অধিবাসীরা তাদের ধর্ম মতে মৃতের জন্য কিছু প্রথাগত অনুষ্ঠান পালন করতো, যাতে করে মৃত সহজে পাতাল যাত্রার ভেতর দিয়ে পাতালে পৌঁছতে পারে। মৃত্যুর খেয়াদেবতা চারোন মৃতকে পাঁচটি নদীর ভেতর দিয়ে নিয়ে যেতো। নদীগুলো ছিলো – ঘৃণার নদী, দুঃখের নদী, বিস্মরণ প্রবণতার নদী, কান্নার নদী ও আগুনের নদী। এই পাঁচটি নদী পার হয়ে মৃতটি পাতালে তার জীবন শুরু করতে পারতো। বিষয়টি হিন্দু পূরাণের বৈতরনী নদী পার হয়ে নরকে পৌঁছার মতো, সেখানে শুধু কলুষিত আত্মারা বৈতরনী নদী পার হয়ে নরকে যায়।
মৃতের আত্মাকে চারোনের নৌকার ভাড়া বাবদ দিতে হয় একটি পয়সা। এ কারণে প্রাচীন গ্রীসের লোকেরা মৃতের সাথে বা তার মুখের উপর পয়সা রেখে দিতো। যারা চারোনকে এই পয়সা দিতে পারতো না সে সকল নতুন আত্মাকে নদী তীরে একশো বছর অপেক্ষা করতে হতো। হেডেজের এই পাতাল মাঝি অন্য সকল দেব-দেবীদেরকে পাতালে আনা নেয়ার কাজটি করতো।
সময়ের সাথে মানুষ বিভিন্ন রকম পূরাণের সৃষ্টি করেছে, কেউ সে পুরাণের সাথে থেকেছে আবার কেউ ধর্ম বা তার সমগোত্রের সাথে জীবনাচার পালন করেছে। যা কারো কাছে পুরাণ তা কারো কাছে ধর্ম, আবার কারো পুরাণ অন্য কারোর কাছে সত্য। কারো বিশ্বাস অন্যকারো কাছে হয়তো কল্পিত কিছু। পৃথিবীর সব অঞ্চল জুড়েই ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন রকম পুরাণ – ভারতীয়, গ্রীসিয়, জাপানীজ, চায়নীজ, মিশরীয় ইত্যাদি পুরাণ। দেবতাদের সাথে মানুষের পার্থক্য হলো – মানুষ মরণশীল, কিন্তু দেবতারা মরে না। আবার দেবতা হয়ে জন্মেও পুরাণ অনুসারে অনেক দেবতার মৃত্যু হতে দেখা যায়। মানুষ মনের মাধুরি মিশিয়ে কল্পনায় এঁকেছে দেব-দেবীর মুখ; তারপর গড়েছে তার রূপ বিশ্বাস, গল্প কিংবা অবকাঠামোয়।
দৈববাণী ও বিসর্জনেরও বিরাট ভূমিকা ছিলো প্রাচীন গ্রিসে। যা পুরাণের পাশাপাশি মানুষের জীবনেও অর্পিত হয়। ডেলফির দৈববাণী বিভিন্ন কাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডেলফির সে সব দৈববাণী প্রাচীন গ্রিসের মানুষকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। দৈবজ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিদেরও সে সময় গ্রীকবাসীরা বিশ্বাস করতো, দৈবজ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিরা দেবতাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ আছে বলে প্রচার করতো। লোককথা অনুসারে তারা উপাসনালয়ে যেয়ে দেবতাদের সাথে যোগাযোগ করতো ও ভবিষ্যৎ বলতে পারতো, যা নিঃসন্দেহে গ্রীক বাসিদের সাহায্য করতো।
গ্রীক পুরাণ ও লোককাহিনী অনুসারে প্রচুর ভয়ংকর দৈত্যের কথা শুনা যায়। ঐ সকল প্রাণীর ভেতর ড্রাগন, পিচাশ, দানব, ভূত ও মাথাওয়ালা স্ফিংক্স, অর্ধমানব, গ্রিফিন প্রভৃতি ছিলো।
গ্রীকদের ছিলো মোট ২৪ বর্ণের বর্ণমালা। সাইন্সের ছাত্ররা এসব অনেক বর্ণের সাথে ইতোমধ্যেই পরিচিত হয়েছেন, যেমন – পাই, আলফা, বিটা, গামা, সিগমা, টাউ প্রভৃতি।
অপহরণের গ্রীক মিথ – পাতাল দেবতা হেডেজ ও দেবী পার্সেফোন
04জু
পাতাল দেবতা হেডেজ হলো দেবাধিপতি তথা আকাশ ও বজ্র দেবতা জিউসের ভাই। আর ফসল বা নিসর্গের দেবী ডিমিটারের কন্যা হলো তারুণ্য ও বসন্তের উদারতার দেবী পার্সেফোন। যদিও জিউসের শয্যাসঙ্গী ছিলো ডিমিটার, তবুও পার্সেফোন যে জিউসের কন্যা তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না! সে যাই হোক, মূল গল্পে আসি। একদিন পাতাল দেবতা হেডেজ হঠাৎ অনন্ত যৌবনা প্রাণবন্ত পার্সেফোনকে দেখে ফেলে, আর তৎক্ষণাৎ তার প্রেমে পড়ে যায়। তারপর দেবতা পাতাল ছেড়ে ভূপৃষ্ঠে উঠে এসে ঘুরতে থাকে পার্সেফোনের আশায়। আর অপেক্ষা করতে থাকে সঠিক সময়ের – ফুল কুড়ানো রাজকন্যা পার্সেফোনকে ধরার জন্য।
প্রেম মতাল হেডেজ তার প্রেমের গোপন কথাটি জিউসকে জানায়, জিউসের সাহায্য কামনা করে। অতঃপর দুই ভাই মিলে পার্সেফোনকে ধরার জন্য একটি পরিকল্পনা করলো। জিউস ধরিত্রী দেবী গায়য়াকে নির্দেশ দিলো মাঠে হলুদ ড্যাফোডিল ফুল ফোটাতে। উদ্দেশ্য ছিলো সে ফুলে পার্সেফোনকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করা।
একদিন সকালে দেবী ডিমিটার তার কন্যাকে নিয়ে অবতরণ করলো মাঠে। সেখানে ডিমিটার সাগর পরী, নদী-ঝর্ণার পরীদের সাথে পার্সেফোনকে ছেড়ে দিয়ে দেবী তার বিশাল শস্যক্ষেত্র দেখতে বের হলো।
পার্সেফোন যখন তার সাথীদের নিয়ে খেলায় ব্যস্ত তখন হঠাৎ তার চোখ গেলো ড্যাফোডিলের দিকে, পার্সেফোন কিছুতেই সে ফুলের থেকে চোখ ফেরাতে পারলো না।
সে তার সঙ্গীদের ডাকলো ফুলের কাছে যেতে। কিন্তু জলপরীরা জানালো যে তারা কিছুতেই জলের এলাকা থেকে বেশী দূরে যেতে পারবে না, দূরের ঐ ফুলের কাছে গেলে তারা মারা যাবে। অগ্যতা পার্সেফোন নাচতে নাচতে একাই গেলো সে ফুলের কাছে এবং ধরিত্রী দেবী গায়য়ার বক্ষস্থল থেকে তুলতে চেষ্টা করলো সে ফুল। পার্সেফোনের প্রায় সবশক্তি চলে গেলো ড্যাফোডিলের গাছ ধরে টানাটানি করতে। অবশেষে উপরানো ড্যাফোডিলের গুচ্ছ হাতে নিয়ে স্মিত হাসলো বালিকা। কিন্তু পরক্ষণেই গাছের উপরানো সে গর্ত ক্রমেই বড় হতে শুরু করলো।
গর্ত বড় হয়ে বিশাল আকার ধারণ করলো আর গ্রাস করতে চেষ্টা করলো পার্সেফোনকে। তীব্র বেগে পার্সেফোন সে গর্তের ভেতর দিয়ে পৌঁছে গেলো পাতালপুরীতে।
পৃথিবীর শষ্যক্ষেত্র দেখে ডিমিটার ফিরে আসলো সেখানে, যেখানে সে রেখে গিয়েছিলো তার কন্যাকে। কিন্তু কোথাও দেখতে পেলোনা পার্সেফোনকে।
শুধু কান্নারত অবস্থায় দেখতে পেলো জলপরীদের। সখীর বিরহে কাতর জলপরী সায়েনের কান্নায় সেখানে সৃষ্টি হলো সায়েন নদীর। ডিমিটারকে তারা কিছুই বলতে পারলো না। শুধুমাত্র জলপরী সায়েন পার্সেফোনের কোমরবন্ধনীটি ধুয়ে বলতে পারলো যে পার্সেফোনের সাথে খুব খারাপ কিছু হয়েছে। ক্রদ্ধ ডিমিটার তার মেয়েকে রক্ষা করতে না পারার অপরাধে পরী সায়েন ছাড়া সেখানকার সকল পরীদের অভিশাপ দিয়ে অদ্ভূত পা বিশিষ্ট ঘৃণীত সাইরেন বানিয়ে দিলো। কুৎসিত মোহিনী নারী সাইরেনরা তখন থেকে নাবিকদের গান শুনিয়ে মুগ্ধ করে তাদের বিনাশ সাধন করতে থাকলো। তাদের ভেসে আসা মায়াবী সুরে নাবিকরা আকৃষ্ট হয়, ভেসে যায় সুরের সন্ধানে। সবশেষে নাবিকদের মৃত্যুপুরীতে নিয়ে যায় সে মায়াবী সুর।
এদিকে হেডেজ পাতালপুরীতে জোর করে তার রানী করে রাখলো পার্সেফোনকে। দেবীর কুমারীত্ব লুন্ঠিত হলো দেবতার হাতে। কিছু ঘোড়ার ডাক শুনা গেলো শুধু; পাতালে প্রতিধ্বনিত হলো আর্তনাদ।
কন্যার শোকে পাগলপ্রায় হয়ে গেলো ডিমিটার, খুঁজে বেড়ালো সারা পৃথিবী। অবশেষে সে দেখা পেলো ডাকিনী, প্রেতাত্মা, মহাজাগতিক, যাদু ও মায়াবিদ্যার দেবী হিকেটের।
ডিমিটারের করুন অবস্থা দেখে হিকেট তাকে সূর্য দেবতা হিলিয়সের সাহায্য নিতে বললো। হিলিয়সের কাছে সাহায্য চাইলে হিলিয়স ডিমিটারকে অপহরণের সব ঘটনা বিস্তারিত জানালো।
তারপর ডিমিটার হেডেজের কাছে তার মেয়েকে ভিক্ষা চাইলো, আরো বললো যে – ফুলসম রাজকন্যা পার্সেফোন কিছুতেই অবরুদ্ধ পাতালে থাকতে পারবে না।
অতঃপর হেডেজ পরামর্শ করলো জিউসের সাথে; ঠিক করলো বছরের ছয় মাস পার্সেফোন পাতালে থাকবে আর ছয় মাস থাকবে তার মায়ের কাছে। পাতাল থেকে ফেরার সময় হেডেজ পার্সেফোনকে ছয়টি ডালিমের দানা খেতে বাধ্য করলো। বলা হয় যে ডালিমের দানা খেলে বন্দীকর্তার কাছে ফিরে আসতে বাধ্য থাকে বন্দী। ছয়টি ডালিমের দানা খেয়ে বছরের ছয় মাস পার্সেফোন বাধ্য হলো পাতালে থাকতে, বাকি ছয় মাস থাকলো সে মায়ের কাছে।
এখান থেকে সে দেশে আসলো বছরে ছয় মাস ব্যাপ্তির বসন্ত ও শীতকাল। যখন পার্সেফোন মায়ের কাছে ফিরে আসে, তখন পৃথিবীতে শুরু হয় বসন্তকাল। আর যখন পাতালে সে ফিরে যায়, তখন শুরু হয় শীতকাল।
এক সময় বাধ্যগত অপ্রত্যাশিত যৌন সম্পর্কটি বসন্ত দেবীর হৃদয়ে ভালোবাসার বসন্ত নিয়ে আসে। পার্সেফোন পাতালের সত্যিকারের রানী হয়ে হেডেজের সাথে শাসন করতে থাকে পাতালপুরী।
পার্সেফোনের মতো এখনো ফুলকুড়ানো ফুলময় মেয়েরা অপহরণের শিকার হয়। ডিমিটারের মত মেয়ের শোকে পাগল হয় কোন মা। পাতাল কিংবা কোন রাজ্যের রানী না হয়ে সে মায়ের রাজকন্যাটি অনেকক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে শরীর বিকিয়ে খায়। এখন আর পেশী শক্তির কাছে হার মেনে সবশেষে ভালোবাসা আসে না বসন্তের মত, শুধু ভাগ্যকে মেনে নিয়ে নিষ্ফল লুকানো ক্রন্দন। সে প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আজও নিরুপায় পার্সেফোনের দেখা মেলে ভিন্ন ভিন্ন অবয়বে!
গ্রিসের প্রারম্ভিক ইতিহাস
04জু
যে গ্রিসের ইতিহাস দিয়েই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে আধুনিক মানুষের সত্যিকার অগ্রযাত্রাটি সূচিত হয়েছিল, কালক্রমে সে অগ্রযাত্রার যুক্ত হয়েছে শিক্ষাসংস্কৃতি ও ইতিহাস-দর্শনের এক আশ্চর্য অধ্যায়। ৫০৮ খ্রিস্টপূর্বে প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স নগরটি মানবসভ্যতার প্রথম গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিত হয়। এ সময় মুক্ত স্বাধীন পুরুষেরা নগর পরিচালনার সিদ্ধান্তের জন্য ভোট দানের অনুমতি লাভ করে। গ্রিক শব্দ demos মানে জনগন। জনগনের শাসনের মানে হল democratia এবং এটিও একটি গ্রিক শব্দ ; এবং এই দেম্যোক্রাতিয়া শব্দটি থেকেই উদ্ভব হয়েছে ইংরেজি democracy শব্দটি।
এখন যে দেশটির নাম গ্রিস- সেখানে কয়েক হাজার বছর ধরেই মানুষ বসবাস করে আসছে। তবে সুপ্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক গ্রিসের আদি অধিবাসীদের সম্বন্ধে সন্তোষজনক তেমন তথ্য এখনও জোটেনি। অবশ্যি প্রত্নতাত্ত্বিকগন ৬০০০ থেকে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্ব প্রাগৈতিহাসিক গ্রিসের অধিবাসীদের সম্বন্ধে জরুরি তথ্যাদি উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন; পন্ডিতেরা মনে করেন আদি গ্রিকরা চাষবাস করত আর তারা বাস করত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামীণ কমিউনিটিতে।
৩০০০ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টপূর্ব-এই সময়কালকেই সাধারণভাবে গ্রিক সংস্কৃতি তথা পশ্চিমা সভ্যতার প্রারম্ভ মনে করা হয়। এই সময়কালে গ্রিসের মূলভূখন্ডে বসবাসকারী মানুষের দৈনিন্দন জীবনযাত্রা কিংবা আচার-প্রথা সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায়নি। তাদের পূর্বপুরুষের মতন তারাও সম্ভবত চাষাবাদই করত। যা হোক, ঐ সময়ের ক্রিট দ্বীপের উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। সে সম্পর্কে প্রচুর তথ্য জানা গিয়েছে। রাজা মিনোস ক্রিট দ্বীপ শাসন করতেন। তিনি কিংবদন্তী হলেও ঐতিহাসিক ব্যক্তি বলেই গবেষকদের ধারণা। ক্রিট দ্বীপের রাজধানী ছিল নসস।
ক্রিট দ্বীপের অধিবাসীদের বলা হয় মিনোয়ান। ২২০০ খ্রিস্টপূর্বে সভ্যতাটির সূচনা হয়েছিল। মিনোয়ানরা আশ্চর্য সব প্রাসাদ নির্মাণ করেছিল। সে প্রাসাদে ছিল আধুনিক পয়ঃপ্রণালী। শক্ত হাতে তারা সমুদ্র শাসন করেছিল। ১৪৫০ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ ক্রিটসভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেলেও সভ্যতাটি ধর্ম শিল্পকলা ও সংস্কৃতিক দিক দিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।
১৬৫০ খ্রিস্টপূর্বে মাইসিনি পরিনত গ্রিসের সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে। সমৃদ্ধশালী ও শক্তিশালী ওই নগরটির অবস্থান ছিল পেলোপেননেসাসে। পেলোপেননেসাসে-র লোকজন যে ভাষায় কথা বলত সে ভাষাই পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছে আধুনিক গ্রিকভাষা।
পেলোপেননেসাস। পশ্চিমে আইয়োনিও সমুদ্র, দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর; উত্তরে বিখ্যাত দেলফি, পুবে এথেন্স নগর।
যাই হোক। ১৬৫০ খ্রিস্টপূর্বের পর থেকে গ্রিসের মূলভূমিতে আরও অনেক নগর গড়ে উঠতে লাগল। মাইসিনি-র সমকালীন আরও তিনটি নগর হল থিবস, স্পার্টা এবং এথেন্স।
গ্রিক সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নগরও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। এই নগরগুলি ছিল স্বাধীন ও স্বতন্ত্র। তবে দুটি বিষয় এদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল। ১. ভাষা। ২. অভিন্ন ঐতিহ্য। তারা ভাবত তারা হেললেন- এর বংশধর । হেললেন ছিলেন গ্রিকজাতির কিংবদন্তী জনক। তারা নিজেদের বলত ‘হেলেনেস’। আজও আধুনিক গ্রিসের নাম হেল্লাস।
আজ আমরা যাদের গ্রিক বলে জানি, সেসময় তারা ঐকবদ্ধ ছিল না। সমগ্র গ্রিসের কোনও একক শাসক ছিল না। যুদ্ধও হত। ট্রয় নগর ছিল এশিয়া মাইনরের (বর্তমান তুরস্ক) পশ্চিমে। একাদশ খ্রিস্টপূর্বে ট্রয় নগরটি ধ্বংস করা হয়। এই নগরটি ধ্বংসে জন্য সর্বপ্রথম গ্রিকরা ঐকবদ্ধ হয়। হেলেন ছিলেন স্পাটার রাজা মেনেলাউসের স্ত্রী। সুন্দরী হেলেন কে উদ্ধারের জন্যেই এই ঐক্যবদ্ধ অভিযান পরিচলানা করা হয়।
ট্রয় অভিযানের পর গ্রিক মূলভূমির অনেক নগর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। গ্রিকরা এই ধ্বংসলীলার জন্য দায়ি করে গ্রিকভাষী এক জাতিকে। সেই জাতির নাম ডোরিয়ান।
ডোরিয়ান অভিযান। মধ্য গ্রিসে ছোট এলাকার নাম ছিল ডোরিস। ডোরিয়ানদের উৎপত্তি সেখানেই মনে করা হয়। সম্ভবত এরা ক্রিটেও বাস করত। ঐতিহাসিক হেরোডোটাস এদের এথনোস। এই এথনোস শব্দ থেকেই উদ্ভব হয়ে ইংরেজি এথনিক শব্দটি।
৮০০ খ্রিস্টপূর্ব। এ সময়ে ফিনিশিয় বর্ণমালার আদর্শে গ্রিক বর্ণমালার উদ্ভব হয়। এর ফলে গ্রিসের মূলভূমি ও আশেপাশের দ্বীপসমূহে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি লক্ষ করা যায়। ঐ সময়ে গ্রিকরা ‘পলিস’ এ বাস করত। ‘পলিস’ অর্থ নগর রাষ্ট্র। এর পৃথক রাজনৈতিক সত্তা ছিল।
৫০৮ খ্রিস্টপূর্বে প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স নগরটি মানবসভ্যতার প্রথম গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিত হয়। এ সময় মুক্ত স্বাধীন পুরুষেরা নগর পরিচালনার সিদ্ধান্তের জন্য ভোট দানের অনুমতি লাভ করে। গ্রিক শব্দ demos মানে জনগন। জনগনের শাসনের মানে হল democratia এবং এটিও একটি গ্রিক শব্দ ; এবং এই দেম্যোক্রাতিয়া শব্দটি থেকেই উদ্ভব হয়েছে ইংরেজি democracy শব্দটি।
অবশ্য নাগরিকরাই ভোট দিতে পারত। যে কোনও এথেন্সবাসীই গ্রিক নাগরিক ছিল না। ওই সময়ে অনেক গ্রিক পরিবারে দাস ছিল। দাসরা আসলে ছিল যুদ্ধবন্দি। দাসেরা এথেন্সের নাগরিক ছিল না। তাদের ভোটাধিকার ছিল না। প্রাচীন গ্রিসের নগররাষ্ট্রে নারীদেরও ভোটদানের অধিকার ছিল না।
এথেনিয় গনতন্ত্রের উদ্ভবকালে অর্থাৎ ৫ম ও ৬ষ্ট শতকে -দর্শন ইতিহাস চিকিৎসাশাস্ত্র এবং শিল্পকলায় প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়। এই উন্নতি ছিল এথেন্সকেন্দ্রিক; ঐ সময়কার বিশ্বের জ্ঞানীগুণিরা এথেন্স নগরে এসে জড়ো হতেন। এই সময়কালকে গ্রিসের স্বর্ণযুগ বা প্লেরিক্লিয় স্বর্ণযুগ বলা হয়। পেরিক্লেস ছিলেন ঐ সময়ের শাসক।
ম্যাসিডোনিয়া রাজ্যটি ছিল উত্তর গ্রিসে। ৩৩৮ খ্রিস্টপূর্বে ম্যাসিডোনিয়ার রাজা ২য় ফিলিপ গ্রিসের অধিকংশ স্থান দখল করেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে আলেকজান্দার এই দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন।
আলেকজান্দার এর উন্নতির শিখরে তার সাম্রাজ্য পুবে ভারতবর্ষ অবধি বিস্তৃত ছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের দিকে রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি গ্রিকসাম্রাজ্যটি রোমান সাম্রাজ্যে নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। তবে গ্রিকদের জীবনধারা, আচার- প্রথা ধর্মবিশ্বাস ও উপকথা রোমানরা গ্রহন করে।
গ্রীক পৌরানিক সৃস্টি তত্ব(Greek Creation Myth)
04জু
কিভাবে পৃথিবী, আকাশ,গাছপালা, সমুদ্র, গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদি এল সে রহস্যের আজও উত্তর নেই। এখনকার মত আদিমযুগেও সৃস্টি নিয়ে ভেবেছে মানুষ। খৃস্টপূর্ব প্রাচীন গ্রীস দেশে সৃস্টি সম্পর্কে বেশ কিছু পৌরানিক ঊপাখ্যান ছিল। তার একটা হল -
সৃস্টির শুরুতে পৃথিবী ছিল না,সমুদ্র ছিল না, আকাশ ছিল না , ছিল শুধু অসীম অনন্ত শুন্যতা, বিশৃংখল নিরাকার অন্ধকার। সৃস্টির জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুই ছিল কিন্তু তার কোন গুনাবলি ছিল না, পৃথিবীর আকার ছিল না ,পানির তরলতা ছিল না আকাশে আলো ছিল না।সমস্ত পদার্থের বিপরীতধর্মী জিনিস ছিল । গরম যেমন ছিল তেমনি ছিল ঠান্ডা, ভেজার সাথে শুকনা, ভারীর সাথে পাতলা ইত্যাদি।
একটা মাত্র পাখি ছিল, নাম তার নিক্স( Nyx)। কালো ডানার পাখি নিক্স সোনালী ডিম পেড়ে যুগের পর যুগ তাতে “তা” দেওয়ার পর একদিন প্রানের লক্ষন দেখা গেল এবং আরো কিছুদিনপর ডিম ফেটে জন্ম নিলেন ভালবাসার দেবতা এরোস (Eros) । ডিমের খোসার এক অংশ বাতাসের উপরে উঠে গিয়ে হল আকাশ আর অপর অংশ হল পৃথিবী। এরোস আকাশের নাম রাখলেন ইউরেনাস (Uranus) আর পৃথিবীর নাম রাখলেন “গাইয়া(Gaia), তারপর এরোস, গাইয়া এবং ইউরেনাসের মনে ভালবাসা সঞ্চার করলেন।
গাইয়া এবং ইউরেনাসের অনেক সন্তান সন্ততি হল, নাতিপুতি হল।এদের মধ্যে একজন ছিলেন ক্রোনাস (Kronus)। ক্রোনাস তার সন্তানদের কেউ হয়ত তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর হয়ে যাবে এই ভয়ে জন্ম মাত্রই তাদের গিলে খেয়ে ফেলতে লাগলেন। কিন্তু ক্রোনাস স্ত্রী রিয়া(Rhea) তাদের সবচে ছোট সন্তানকে লুকিয়ে রাখলেন। যখন ক্রোনাস সন্তান চাইলেন তিনি কম্বলে জড়ানো এক টুকরো পাথর দিলেন আর ক্রোনাস তাই গলাধঃকরন করলেন।
এই সন্তান হলেন জিউস (Zeus )। জিউস যখন বড় হলেন তখন বাবার হাত থেকে তার ভাই বোনদের কৌশলে রক্ষা করতে থাকলেন। তারপর জিউসে্র নেতৃত্বে পিতার বিরুদ্ধে তারা অনেক বছর যুদ্ধ করে জয়ী হলেন। তারা আকাশকে গ্রহ নক্ষত্র দিয়ে সাঁজালেন আর পৃথিবীতে সাঁজালেন প্রানী দিয়ে। এরপর জিউস তার দুই পুত্র প্রমিথিউস Prometheus (fore-thought) এবং এপিমেথিউস Epimetheus (after-thought) এই দুজনকে পৃথিবীতে পাঠালেন মানূষ এবং অনান্য প্রানী তৈরী করে প্রত্যেককে একটা করে উপহার দিতে।
প্রমিথিউস দেবতাদের অনুকরনে সৃস্টি করলেন মানুষ এবং এপিমিথিউস সৃস্টি করলেন অনান্য প্রানী। এপিমিথিউস অনেক আগেই প্রানী সৃস্টি করে প্রত্যককে উপহার দিলেন। মানুষ সৃস্টি শেষ হলে প্রমিথিউস যখন তাদের উপহার দেওয়ার জন্য এলেন এপিমিথিউস তাকে লজ্জিতমূখে জানালেন আর কোন উপহার অবশিস্ট নেই, সবই দিয়ে ফেলেছেন প্রানীদের। তখন বিষন্ন প্রমিথিউস ঠিক করলেন মানুষকে তিনি আগুন উপহার দেবেন।
পরদিন সকালে সূর্য্য আকাশে ওঠার পর তিনি সেখান থেকে আগুন চূরি করে এনে মানূষদের কে আগুনের ব্যাবহার শেখালেন। আগুনের উপর দেবতা ছাড়া অন্য কারো ব্যবহার করার অধিকার ছিল না। জিউস প্রমিথুসের এই কাজ জানতে পেরে তাকে শাস্তি স্বরুপ এক পাহাড়ের সাথে বেধে রাখলেন। অনন্ত কাল ধরে প্রতিদিন শকুনে এসে তার লিভারের কিছু অংশ খেয়ে যায়।
জিউসের অপর এক সন্তান তৈরী করলেন অপূর্ব সুন্দরী রমনী, নাম তার প্যান্ডোরা( Pandora), সমস্ত দেবতারা প্যান্ডোরাকে উপহার দিলেন। জিউস উপহার দিলেন কৌতুহল এবং একটা বাক্স। তিনি কিন্তু প্যান্ডোরা কে নিষেধ করে দিলেন কখনই সে বাক্স না খুলতে।
তারপর প্যান্ডোরার সাথে এপিমিথিউসের বিয়ে হল।তারা সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন । প্যান্ডোরার মনে সব সময় সেই বাক্স খুলে দেখার কৌতুহল। কি আছে সে বাক্সে? একদিন এপিমিথিউস যখন বাইরে গেলেন প্যান্ডোরা খুললেন সে বাক্স আর মূহুর্তেই বেরিয়ে এল ভয়ঙ্কর খারাপ সব জিনিস যেমন ব্যাথা বেদনা, রোগ শোক, লোভ লালসা। প্যান্ডোরার চিৎকার শুনে এপিমিথিউস তাড়াতাড়ি ফিরে এসে বন্ধ করলেন সে বাক্সের ঢাকনা।
কিন্তু যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, বেরিয়ে গেছে মানুষের কস্টের সমস্ত উপকরন। সেদিন রাতে তারা শুনতে পেলেন বাক্সের ভেতর থেকে এক ক্ষীন কন্ঠ। “ কে ওখানে? জিজ্ঞেস করলেন তারা । বাক্সের ভেতর থেকে উত্তর এল “আমি আশা , আমাকে মুক্ত করে দাও । তারা ঢাকনা খুললেন বেরিয়ে উড়ে গেলেন আশার দেবী। আশা নিয়েই মানূষ বেচে আছে আর ইহ জীবনে ভোগ করে দুখঃ, বেদনা ,রোগ, শোক ইত্যাদি।
গ্রিক মিথ : প্যান্ডোরার বাক্স
04জু
প্রোমিথিউস। সম্ভবত গ্রিক উপকথার সবচে জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় চরিত্র। প্রোমিথিউস মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্য স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করেছিলেন ; এটিই প্রোমিথিউস এর জনপ্রিয়তার কারণ। স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে আনার কারণে প্রোমিথিউকে অকল্পনীয় শাস্তি দিয়েছিলেন দেবতা জিউস। এসব কথা আমরা জানি। কিন্তু, আমরা কি জানি যে দেবতা জিউস আগুন ব্যবহার করার জন্য মানবজাতিকেও ভয়ানক শাস্তি দিয়েছিলেন? … আজও যে মর্মান্তিক শাস্তি সমগ্র মানবজাতি ভোগ করছে । গ্রিক উপকথা অনুযায়ী: আজ যে মানবসমাজে ঘৃনা ক্রোধ লোভ রোগব্যাধি দগদগে ঘায়ের মতন ছড়িয়ে আছে – এসবই মানবজাতির প্রতি দেবতা জিউস-এরই শাস্তি । তবে দেবতা জিউস পৃথিবীতে এসব অশুভ বিষয় প্রত্যক্ষভাবে পাঠান নি। যেন অশুভের দায়ভার তার ওপর কখনোই না-বর্তায় সে জন্য তিনি এক হঠকারীতার আশ্রয় নিয়েছিলেন। পৃথিবীতে ঘৃনা ক্রোধ লোভ রোগব্যাধি পাঠাতে দেবতা জিউস সুকৌশলে বেছে নিয়েছিলেন নারীর এক বিশেষ দূর্বলতা। সে দূর্বলতার নাম: ‘কৌতূহল’ …
দেবতা জিউস । এই দেবতার নষ্টামির বর্ণনা গ্রিক পুরাণে রয়েছে। অসম্ভব ক্ষমতাপরায়ণ দেবতা জিউস। জিউস টাইটানদের উৎখাত করে পৃথিবীতে তাঁর শাসন কায়েম করেছিলেন। ( ইউরেনাস এবং গেইয়ার বারো সন্তান টাইটানরা হিসেবে পরিচিত । এদের গ্রিক পুরাণে প্রি-অলিম্পিয়ান দেবতা বলা হয়। এরা এককালে পৃথিবী শাসন করত। )
প্রোমেথিউস ছিলেন টাইটানদেরই একজন। টাইটান হলেও মানুষ পছন্দ করতেন। মানবসমাজে ঘৃনা ক্রোধ অসুখ দারিদ্র নেই। (কারণ তখনও প্যান্ডোরার অশুভ বাক্সটি খোলা হয়নি) প্রোমেথিউস মানুষকে যথাসাধ্য সাহায্যও করতেন। তবে তিনি লক্ষ করেছেন মানুষ শীতরাত্রে কাঁপে, কাঁচা মাংস খায়। তিনি উপলব্দি করেছিলেন মানুষের দরকার আগুন । আগুন পেলেই সে উন্নত এক মানবসমাজ নির্মান করতে পারবে। তবে দেবতা জিউস আগুন দেবে না। কেন ? দেবতা জিউস এর ধারণা আগুন পেলেই মানুষ এর অপব্যবহার করবে। নিজেকে ধ্বংস করবে। অথচ প্রোমেথিউস-এর বিশ্বাস ভালো মানুষ আগুনের সঠিক ব্যবহারই করবে। (এ প্রসঙ্গে আমরা বর্তমানকালের পরমাণু শক্তির ব্যবহার এবং দূর্ঘটনার আশঙ্কায় ইউরোপে পরমাণু শক্তির ব্যবহার বিরোধী আন্দোলনের কথা স্মরণ করতে পারি…) যা হোক। প্রোমেথিউস স্বর্গ থেকে চুরি করে মানুষকে দিলেন। দেবতা জিউস ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠলেন। পাহাড়চূড়ায় প্রোমেথিউসকে শেকল দিয়ে বাঁধলেন। যেন শকুন এসে প্রতিদিন প্রোমেথিউসের শরীরের মাংস ঠুকরে খেতে পারে!
দেবতা জিউস এবার মানবজাদিকে কঠিন শাস্তি দেবার কথা ভাবলেন। সূক্ষ্ম পরিকল্পনা আঁটলেন। কামার দেবতা হেফুস্তুস কে ডেকে পাঠালেন দেবতা জিউস। কামার দেবতা হেফুস্তুস এলেন।
দেবতা জিউস কামার দেবতা হেফুস্তুস কে বললেন, আমার ইচ্ছে তুমি
জলকাদা দিয়ে মূতি তৈরি কর।
কামার দেবতা হেফুস্তুস বললেন, আপনার আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করব দেবরাজ।
দেবতা জিউস এবার সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতিকে ডাকলেন।
আফ্রোদিতি এলেন।
দেবতা জিউস সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতিকে বললেন, সুন্দর ভঙ্গিমায় এখানে দাঁড়াও।
কেন? আফ্রোদিতি তো অবাক।
দেবতা জিউস বললেন, কামার দেবতা হেফুস্তুস তোমাকে দেখে জলকাদা দিয়ে একটি মূর্তি তৈরি করবে।
ও। বলে আফ্রোদিতি সুন্দর ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন।
মূর্তি নির্মাণ শেষ হল।
দেবতা জিউস মূর্তি তে জীবন দান করলেন।
প্রাণ পেল পৃথিবীর প্রথম নারী। অপরূপ সুন্দর। কেননা, সুন্দরী আফ্রোদিতির আদলে গড়া হয়েছে।
দেবতা জিউস এবার অন্যান্য দেবতাদের ডাকলেন। একে একে দেবতারা সব এলেন। অ্যাপোলো। হার্মিস। দেবতা জিউস তাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর প্রথম নারীর পরিচয় করিয়ে দিলেন । বললেন, এ হল আমার কন্যা। একে তোমাদের গুণ দান কর।
অ্যাপোলে দান করলেন সংগীত। হার্মিস দান করলেন প্ররোচনার ক্ষমতা।
এ কারণে পৃথিবীর প্রথম নারীটির নাম রাখা হল প্যান্ডরা। অর্থ: ‘সর্ব-উপহার’।
দেবতা জিউস এবার প্যান্ডোরাকে একটি সুন্দর বাক্স দিলেন।তারপর বললেন, এই বাক্সটা কখনও খুলিস না মা।
কি আছে এতে? প্যান্ডোরা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল।
দেবতা জিউস মনে মনে হাসলেন। তারপর বললেন, আহা, যাই থাক। বললাম তো বাক্সটা কখনোই খুলবি না।প্যান্ডোরা কৌতূহল বোধ করলেও বলল, আচ্ছা বাবা। খুলব না। কথা দিলাম।
দেবতা জিউস এবার পরিকল্পনা মাফিক তাঁর কন্যাকে পৃথিবীতে, অর্থাৎ গ্রিসে পাঠালেন ।
সেই অরণ্য-পথে যাচ্ছিল এপিমেথিউস। সম্পর্কে সে প্রোমেথিউস- এর ভাই । এপিমেথিউস প্যান্ডোরাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। এই গভীর বনে কে এই সুন্দরী মানবী? মনে মনে ভাবল সে। নিঃসঙ্গ মানবীর দেহে অথই রূপ-যৌবন । রূপসী নারীকে একা পেতে চায় এপিমেথিউস …
এপিমেথিউস প্যান্ডোরাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল।
এই গভীর অরণ্যে বসে থেকেই-বা কী লাভ! এই ভেবে প্যান্ডোরা বিয়েতে রাজি হল।
বিয়ের পর নবদম্পতির জীবন সুখে কাটছিল।
… ওদিকে পাহাড়ের চূড়ায় বন্দি প্রোমিথিউস।
প্রত্যহ উড়ে আসে ক্ষুধার্ত শকূন।
খুবলে খায় বিদ্রোহীর শরীর !
প্যান্ডোরার কাছে বাক্সটি দেখেছে এপিমেথিউস। তার যে কৌতূহল হয়নি তা কিন্তু নয়। কিন্তু প্যান্ডোরা স্বামীকে বলল, তুমি কখনও ওই বাক্স খুলো না। খুললেই কিন্তু সর্বনাশ হবে।
আচ্ছা। খুলব না। এপিমেথিউস স্ত্রীকে বলে।
প্যান্ডোরার বিবাহিত জীবন সুখে কাটছে ঠিকই তবে বাক্সে কি আছে তা দেখার জন্য তাকে সর্বক্ষণ এক অস্বস্তিকর কৌতূহল গ্রাস করে রাখে। । এ এক ভীষণ যন্ত্রণা। না পারে খুলতে, না পারে সইতে …
একদিন। এপিমেথিউস ঘুমিয়ে ছিল।
বাক্সটা খোলার জন্য প্যান্ডোরার কৌতূহলের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেল।
ও বাক্সটা খুলল।
বাক্স খুলতেই পৃথিবীময় ঘৃনা ক্রোধ অসুখ দারিদ্র ইত্যাদি নানা অশুভ ছড়িয়ে পড়ে; প্যান্ডোরা চটজলদি বাক্স বন্ধ করে দেয়।
তার আগেই অবশ্য আশা বেরিয়ে পড়ে।
সুতরাং, আজও মানবসমাজের সার্বিক পরিস্থিতি যতই মন্দ হোক না কেন- মানুষ কখনোই আশা হারায় না।
কিন্তু, মানবসমাজে আশা জিইয়ে রাখাটাও কি দেবতা জিউস- এর পরিকল্পনার অংশ?
সম্ভবত। কারণ তিনি সবই জানতেন।
আর গ্রিক পুরাণরচয়িতারা তো দেবরাজ জিউসকে অত বিবেচনাবোধহীন করে উপস্থাপন করতে পারেন না …